প্রচন্ড বাতাস। তবে সেই বাতাসে শীতলতা নেই, বরং অস্বস্তিকর গরম। এই গরম নাকি আরও বাড়বে এপ্রিল-মে মাসে। এই গরম সহ্য করেই তপ্ত মাটিতে ফসল ফলাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বলছিলাম ওমানের সালালাহর কথা।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত মরুভূমির এ দেশ কৃষি উৎপাদনে দিন দিন সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্যে মরুর বুকে কৃষির সূচনা প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের হাত ধরেই। আমি একাধিকবার তুলে ধরেছি সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার এবং ওমানে বাংলাদেশিদের কৃষি কার্যক্রম।
অনেকেই শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কৃষিকে ঘিরে হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বরিশালের মঠবাড়িয়ার রাজ্জাকের কথা। যিনি মরুর বুক থেকে পাথর সরিয়ে সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছেন ফসলের চাষ। মাঠের পর মাঠ এখন সবজির ক্ষেত। আর চট্টগ্রামের ফরিদ তো কাতারে গাধা দিয়ে হালচাষ করে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন।
শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি এক টুকরো জমি লিজ নিয়ে ভাবলেন কৃষিকাজ করবেন। তার কথা শুনে সবাই বোকা ভাবল তাকে। মরুর পাথুরে ভূমিতে ফসল হয় নাকি! কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আরবীয় মালিকের কাছে আবদার করতেই থাকলেন, ‘একটু জমি দেন আমি চাষাবাদ করব।’ শেষে আরবীয় শেখ ভাবলেন এক টুকরা জমি দিয়ে দিই যা ইচ্ছে করুক।
ফরিদ জমি পেয়ে খুশি হলো ঠিকই, কিন্তু জমিতে গিয়ে দেখে পাথর আর পাথর। একটা একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জমা করল। হাল দেওয়ার লাঙল নেই, নেই গরু। লোহার পাইপ দিয়ে লাঙ্গল বানিয়ে গাধা দিয়ে হালচাষ করে সেই জমিতেই ফসল ফলালেন তিনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সফলভাবেই মরুর বুকে সবুজ ফসল ফলালেন। এর আগে আমি ওমানের বেশ কয়েকজন কৃষি উদ্যোক্তার কথা তুলে ধরেছি। বলেছি তাদের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প।
আরব সাগরের পাশে ওমানের সালালার হাফা নামের অঞ্চলটি ওমানের অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটাই সবুজ। ওখানকার মাটি তুলনামূলক উর্বর ও চাষ উপযোগী। মাটির উর্বরতার গুরুত্বটি অনুধাবন করেই অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি সেখানে সূচনা করেছেন কৃষি কাজের। আগেই বলেছি, প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাধারণত অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে ওমান বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যান। কিন্তু কৃষি ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে তারা যেখানেই গিয়েছেন বিস্তার ঘটিয়েছেন কৃষির।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে ভাগ্যের সন্ধানে শ্রমিক হিসেবে নেয়ামত আলী ওমানের সালালায় গিয়েছিলেন ২০০৮ সালে। কিন্তু জীবনের নানানরকম চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের খোঁজ পেয়েছেন কৃষি খামারেই। বয়স খুব বেশি হলে ৪০ হবে। চোখে-মুখে অদ্ভুত সারল্য। আমাকে দেখেই এগিয়ে এলেন। খামারে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলে চলেন প্রবাস জীবনের সংগ্রামের কথা। প্রথম প্রবাসে এসে কাজ নিয়েছিলেন ফোনের দোকানে। ডিউটির কোনো টাইম টেবিল নেই। নেই রুটিন জীবন। সেই কাজ করে গেছেন বছর দুয়েক। এরপর যুক্ত হলেন আইসক্রিম কোম্পানির বিক্রয়কর্মী হিসেবে। সেখানেও পরিশ্রম অনেক। শ্রমের তুলনায় আয় কম। ভাবছিলেন কীভাবে জীবনে সচ্ছলতা আনা যায়।
ইউটিউবে বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের কৃষি আয়োজন দেখে ভাবলেন তিনিও চেষ্টা করবেন কৃষিতে কিছু করার। সেই থেকে শুরু। এখন নেয়ামত আলী ১২ বিঘা জমিতে করছেন বাণিজ্যিক চাষাবাদ। কলা আর পেঁপের মাঝখানে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করছেন পানের। আমাদের দেশে পান যেমন বরজে চাষ হয়, ওমানে পান চাষ হচ্ছে খোলা ক্ষেতে। এমন পানের চাষ আমি মালদ্বীপে দেখেছিলাম।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পানের বড় বাজার রয়েছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত পান বিশ্বের হোলসেল মার্কেটগুলোতে যায় না। মনে পড়ছে ইংল্যান্ডের লন্ডন ও বার্মিংহাম হোলসেল মার্কেটে পাশের দেশের পান পেলেও আমাদের দেশের পান কোথাও খুঁজে পাইনি। নেয়ামতের এখানে উৎপাদিত পান চলে যায় ওমানের বিভিন্ন শহরসহ দুবাইয়ে।
করোনা পরিস্থিতি আর বৈশ্বিক যুদ্ধ সংকটে বিপর্যস্ত পৃথিবীর সব কৃষক। ফসল উৎপাদনে এখন বহুবিধ চ্যালেঞ্জ। নেয়ামত আলীকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে সেসব। তিনি জানালেন, আগের চেয়ে সারের দাম বেড়েছে। বেড়েছে কৃষির অন্য উপকরণগুলোর দাম। সারের পাশাপাশি ফসল উৎপাদনের অন্যতম উপকরণ বীজ। বীজ নিয়েও সংকট রয়েছে এখানে। বললেন, বাংলাদেশ থেকে ফসলের বীজ নিয়ে আসা কঠিন।
বাংলাদেশের মানুষ মানেই কৃষি সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা, সেখান থেকেই ভিতরে কৃষির প্রতি টান আর নানান রকম অভিজ্ঞতা সঞ্চিত। তারই প্রতিফলন নেয়ামত আলীর কৃষি অভিযান। আগে কৃষিকাজ তেমন না করলেও বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে ঠিকই কৃষিতে সাফল্য অর্জন করেছেন। সে ক্ষেত্রে কৃষি অনুষ্ঠান তার কাছে দারুণ এক অনুপ্রেরণা। কৃষিকে ঘিরে যে উৎপাদন বাণিজ্যের খাত তৈরি করেছেন নেয়ামত, তা নিয়ে তিনি সুখে আছেন। নিজের পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এখানেই থেমে যেতে চান না তিনি। তার স্বপ্নের পথ আরও বহুদূর হেঁটে যাওয়ার।
তিনি বলছিলেন, ওমান সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের নীতিগত সিদ্ধান্তে দুয়ার খুলেছে নতুন সম্ভাবনার। আগে ওমানে প্রবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইসেন্স পেত না। এখন লাইসেন্স দিচ্ছে। ফলে কৃষিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এখানে তৈরি হচ্ছে নানামুখী উদ্যোগের সুযোগ। প্রবাসীরা চাইলেই কৃষিতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
কৃষিতে বিনিয়োগ বিষয়ে তখন কথা হয় ওমান প্রবাসী ব্যবসায়ী সিআইপি ইয়াসিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হলেও অনেক বিষয় রয়ে গেছে যেগুলো সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তির মাধ্যমে সহজ করা যায়। যেমন- কোম্পানি তৈরির লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু জমি লিজ নেওয়ার ব্যাপারে দীর্ঘ সময়ের জন্য লিজ না পাওয়া গেলে কৃষি বাণিজ্যের সাফল্য তুলে আনা সম্ভব হবে না।
নানা প্রতিকূলতা আর সংকট অতিক্রম করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশ বিভুঁইয়ে বহু সংগ্রামে অর্জন করছেন সাফল্য। তা থেকেই বাড়ছে রেমিট্যান্স আয়। বিদেশে কাজ করে নিজের শ্রমের বিনিময়ে ভালো রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশের স্বজনদের। তারা ভালো রাখছেন আমাদের, সমৃদ্ধ করছেন আমাদের অর্থনীতিকে। আলো ছড়াচ্ছেন নতুন বাণিজ্যের পথে।
ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাতে কৃষির সম্প্রসারণ কৃষি উপকরণ বাণিজ্যের যে পথ তৈরি হয়েছে, আমাদের সে পথে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। না হলে তাও চলে যাবে অন্য কারও দখলে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post