অর্থ মন্ত্রণালয় স্থবির অর্থনীতিকে চাঙা করতে ১০০ দিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় করণীয়গুলো ইতোমধ্যে নির্ধারিত হয়েছে। নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে পরিকল্পনাটি তুলে ধরবেন। তিনি অনুমোদন দিলেই স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু হবে।
জানা গেছে, সার্বিক পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। গত নভেম্বরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে অবস্থান করছিল। এটি আগামী এপ্রিলের মধ্যে ৭ শতাংশের আশপাশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির নড়বড়ে অবস্থা থেকে এই সময়ের মধ্যে মোটামুটি স্থিতিশীলতায় ফেরানোরও গুচ্ছ পদক্ষেপ থাকছে। নতুন সরকারের নতুন মেয়াদে নতুন মন্ত্রীর হাত ধরে এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে চায় অর্থ মন্ত্রণালয়।
ইতোমধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে জোরালো প্রতিশ্রুতি রেখেছেন নতুন সরকারের নির্বাচিত মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয়গুলোও এখন ইশতেহারের সঙ্গে মিল রেখে তাদের কর্মকাণ্ডের রোডম্যাপ আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করবেন। আজ রোববার নতুন মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেবেন। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই সচিবদের কাছ থেকে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে ধারণা পাবেন তারা। একই সঙ্গে আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনাও মন্ত্রীর কাছে তুলে ধরবেন।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি খুব শিগগির আগামী ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরবেন। তবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো অর্থ মন্ত্রণালয় এই সময়ের মধ্যে কোন কোন লক্ষ্য কোন পর্যায়ে অর্জন করতে চায়, সেটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নাও দিতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিকে আগের মতো স্বস্তির জায়গায় ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রীর প্রথম এবং প্রধান কাজ। তবে সেটি চাইলেই হবে না, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ধরে তার লক্ষ্যগুলো অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। আর সাচিবিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও সেখানে সহায়ক ভূমিকায় থাকবেন।
এই কর্মকর্তারা আরও জানান, এই মুহূর্তে সব মহলেই সবচেয়ে বড় ইস্যু মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে নতুন সরকারের আগামীর পথচলা মসৃণ হবে না। সবার আগে সাধারণ মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। এজন্য চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি কত হলো, সেটি নিয়ে ভাববে না অর্থ মন্ত্রণালয়। কত দ্রুত সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় করা যায় এবং সেখানে কৌশলগত কী কী পদক্ষেপ থাকবে এবং যাতে তার যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটে, সেদিকেই সার্বক্ষণিক নজর থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, আগামী ১০০ দিন নতুন সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে একেবারেই ঋণ না নেওয়ার চেষ্টায় থাকবে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে এবং তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম একটা টুলস হবে। একই সঙ্গে সরকারকে যাতে কম ঋণ নিতে হয়, সে লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরের বাকি সময় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাজেটের অর্থ খরচও কমিয়ে আনা হবে।
প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে আরোপ করা হবে আরও কঠোর বিধিনিষেধ। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যেও যেগুলোর জনসম্পৃক্ততা অপেক্ষাকৃত কম এবং বাস্তবায়ন-পরবর্তী সুফল পেতে বেশি সময় লাগবে—এমন সব প্রকল্পেরও অর্থছাড় সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর বাইরে ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পের অর্থছাড়ে কড়াকড়ি আগের মতোই বজায় থাকবে।
এর পাশাপাশি সরকারের আয়ের উৎস বাড়াতে আগামী ১০০ দিনের মধ্যে করজালের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক করদাতা চিহ্নিত করারও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ট্রাইব্যুনালে আটকে থাকা মামলার জট দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে রাজস্ব আয়ে ফোকাস থাকবে। আমদানি-রপ্তানিতে ঘোষণার যথার্থতা কঠোরভাবে যাচাইয়ে আগের তৎপরতায় আরও জোর দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষার্ধে আরও অধিকতর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রয়োগেই এখন সতর্ক চোখ অর্থ মন্ত্রণালয়ের। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা চান, নীতি সুদহার আরও বাড়িয়ে বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ একেবারে ৯ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখতে। অর্থাৎ এই সময় দেশে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ কত হলো সেটি নিয়েও মাথাব্যথা নেই সরকারের। তবে ভোগ্যপণ্য আমদানি এবং উৎপাদনশীল খাতে বিশেষ করে কৃষি খাতে ঋণের সরবরাহ এই সময় স্বাভাবিক রাখা হবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়ক হবে।
এর পাশাপাশি আসন্ন রমজানে যাতে চাহিদাযোগ্য সব পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে, সে ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ে চাহিদানুযায়ী ডলার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়া হবে। বন্দর থেকে পণ্য খালাসেও সহজ করার বিষয়েও এনবিআরের মাধ্যমে বিভিন্ন কাস্টম হাউসকে কঠোর বার্তা দেওয়া হবে।
কিন্তু আগামী দিনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ যাতে বাড়ে, সে লক্ষ্যে শিগগির নতুনভাবে রোডম্যাপ প্রণয়নের কাজ হাতে নেওয়া হবে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদন কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রেখে বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করা হবে। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের কাছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের সুপারিশ করবে।
এ ছাড়া ক্রমেই দুর্লভ হয়ে ওঠা ডলারের দরকে পরিপূর্ণভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা আপাতত পরিহার করে অর্থনীতির প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রাথমিক চিন্তা রয়েছে। একই সময়ে দেশে যাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে, সেজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, এডিবি, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশকে আগের প্রতিশ্রুত যেসব ঋণ পাইপলাইনে রয়েছে, তার ছাড় বাড়াতে ও দ্রুততর করতে আগামী ১০০ দিনের মধ্যে দফায় দফায় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবে।
একই সময়ে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে এরই মধ্যে যেখানে ঘাটতি ও ফাঁকফোকর চিহ্নিত হয়েছে, তা সবৈভ বন্ধে উদ্যোগ নিতে চায়। রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিকতা বাড়াতে যৌক্তিক সব খাতে নীতিসহায়তা বাড়ানোর সক্রিয় চিন্তা রয়েছে। একইভাবে দেশে ব্যবসা খরচ কমিয়ে আনার বিষয়েও এ সময় বিভিন্ন অংশীজনকে নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে জোরালো পদক্ষেপ নিতে চায় অর্থ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি দূর করার উদ্যোগ থাকবে।
আর্থিক খাতে এরই মধ্যে যেসব সংস্কার শুরু হয়েছে, আগামী ১০০ দিনে তার অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ফলাফল পাওয়ারও লক্ষ্য রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের। তাদের আশা, সামনে আর খেলাপি বাড়বে না। উল্টো কমে আসবে এবং আগের খেলাপিদের থেকে আইন অনুযায়ী আদায় কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি এবং পরিচালনা পর্ষদকে এই সময় পুনর্গঠন করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, চলমান ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন সরকারের সহায়ক হতে যাচ্ছে দেশে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ও তার ফলন মাঠে গড়ানোর মৌসুম। এরই মধ্যে দেশে আমনের ফলন বাজারে গড়িয়েছে উৎপাদিত পেঁয়াজ, আলু, শিম, বেগুনসহ সব ধরনের মৌসুমি সবজিও রয়েছে। আগের তুলনায় এগুলোর দাম এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। সামনে দাম আরও কমবে।
এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, কৃষি, খাদ্য, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআরকে নিয়ে যৌথভাবে কাজ করতে চায় অর্থ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বাজার সিন্ডিকেট রুখতে আইনের শাসন জোরদারেও সরকারের নীতিনির্ধারণীতে সহায়তা চাওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি, ট্যারিফ কমিশন ও প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম আরও গতিশীল করতেও সক্রিয় পরিকল্পনা রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১০০ দিনের এই প্রোগ্রামটাকে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হিসেবে নিতে হবে। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী, গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবায়নযোগ্য হওয়া উচিত। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সবাইকে জানানো উচিত, যাতে মানুষের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে যে ভীতি রয়েছে, তা দূর হয় এবং আস্থা বাড়ে।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘যেসব পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে, তার সবই ভালো দিক। তবে প্রতি মাসে সুদের হার ১ শতাংশ হারে বাড়লে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হবে না। মুদ্রানীতির কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সেটি ১২০ টাকার মধ্যেই রাখা যাবে, যা এই অর্থনীতি নিতে পারবে। সরকারের ব্যয় কমানোর যে লক্ষ্য রয়েছে তা চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে অন্তত ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা কমিয়ে আনতে হবে। তখন সরকারকেও নতুন করে ঋণ নিতে হবে না। এ ছাড়া আরও যেসব উদ্যোগ রয়েছে, তা মুল্যস্ফীতিকে ৭ নামিয়ে আনতে না পারলেও তার কাছাকাছিই থাকবে। সব মিলে পরিকল্পনাগুলো ভালো। তবে বাস্তবায়ন কতটা হয় সেটিই দেখার অপেক্ষা।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post