একদিন রাসুল (সা.) জোহরের নামাজের পর সাহাবায়ে কেরামদের জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে রোজা রেখেছে? হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) উত্তর দিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আজ আমি রোজা রেখেছি।
রাসুল (সা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে গরিব-মিসকিনকে সদাকা করেছে? আবু বকর (রা.) উত্তর দিলেন, ইয়া নবী, আমি আজ গরিব-মিসকিনকে সদাকা করেছি। নবীজি (সা.) আবার প্রশ্ন করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়েছিলে? আবু বকর (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আজ আমি একজন অসুস্থ ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম।
রাসুল (সা.) আবার প্রশ্ন করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে? আবু বকর (রা.) জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি জানাজায় অংশগ্রহণ করেছি। রাসুল (সা.) পঞ্চমবার প্রশ্ন করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে সমঝোতা করেছে? আবু বকর (রা.) উত্তর দিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি সমঝোতা করে দিয়েছি।
অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, যে লোক এই ভালো আমলগুলো করবে, তার প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। (মুসলিম, হাদিস: ১০২৮)
এক রাতে রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.)–এর দরজায় কড়া নাড়লেন। প্রথম ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আবু বকর (রা.) সাড়া দিলেন। রাসুল (সা.) আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখনো ঘুমাওনি? আবু বকর (রা.) বললেন, আপনি যেদিন হিজরতের কথা বলেছেন, সেদিন থেকে আমি আর বিছানায় শরীর লাগাইনি। আমি প্রতিদিন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আপনার অপেক্ষা করি।
নবী (সা.) তাঁকে চার মাস আগে হিজরতের কথা বলেছিলেন। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে আবু বকর (রা.) তিন দিন ও তিন রাত মক্কার সাওর পাহাড়ের গুহায় ছিলেন।
রাসুল (সা.)–এর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) মুসলিম জাহানের খলিফা মনোনীত হন। খলিফা হওয়ার পর সমবেত মুজাহিদ ও আনসারদের উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে খলিফা বানানো হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি চাচ্ছিলাম, আপনাদের মধ্য থেকে কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক।
আমি আপনাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নই। আপনাদের সবার সাহায্য ও পরামর্শ আমার কাম্য। আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি, আমাকে সহযোগিতা করবেন। আর যদি দেখেন আমি ভুল করছি, তাহলে আমাকে সংশোধন করে দেবেন। আমাকে ততক্ষণ মেনে চলবেন, যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মেনে চলি। যদি আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মেনে না চলি, তাহলে আমার প্রতি আপনাদের আনুগত্যের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না।’
রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে আবু বকর (রা.)–এর যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, তার নিদর্শন দুনিয়ায় বিরল। রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি যদি আমার প্রভুকে ছাড়া আর কাউকেও বন্ধু বানাতাম, তবে অবশ্যই আবু বকরকে বানাতাম। (বুখারি)
ইসলামের সেবায় আবু বকর (রা.)–এর ছিল অতুলনীয় অবদান। পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ, প্রথম কোরআন সংকলন এবং প্রথম বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন করে তিনি ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছেন। সাহাবিদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। আবু বকর (রা.) মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
নবুয়ত লাভের ঘোষণার পর মক্কায় সবাই রাসুল (সা.)–এর বিরোধিতা করতে লাগল। সে সময় আবু বকর (রা.) রাসুল (সা.)–কে সাহস ও সঙ্গ দেন এবং বিনা দ্বিধায় তাঁর নবুয়তের প্রতি ইমান আনেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ করেছি।
হজরত আবু বকর (রা.) ছিলেন কুরাইশদের ধনী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের অন্যতম। জ্ঞান, বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা ও সততার জন্য তিনি মক্কায় শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জাহেলিয়া যুগে মক্কাবাসীর রক্তের ক্ষতিপূরণের সব অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো। আরববাসীর বংশ–সংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ।
তাবুক অভিযানের সময় চরম সংকটময় মুহূর্তে তিনি তাঁর সব অর্থসম্পদ রাসুল (সা.)–এর হাতে তুলে দেন। আল্লাহর রাসুল তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িতে কিছু রেখেছ কি? তিনি জবাবে বললেন, তাঁদের জন্য আল্লাহ আর তাঁর রাসুলই যথেষ্ট।
রাসুল (সা.)–এর মুখে মিরাজের কথা শুনে অনেকে যখন তা নিয়ে দ্বিধায় ছিল, তখন আবু বকর (রা.) নির্দ্বিধায় তা বিশ্বাস করেছিলেন। রাসুল (সা.) তাতে গভীর সন্তোষের সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, ‘সিদ্দিক!’ সেই থেকে আবু বকরের উপাধি হয় সিদ্দিক বা অতিশয় সত্যবাদী। আবু বকর (রা.) সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে নবী বলে দাবি করা ভণ্ডদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব মারাত্মক ফিতনার হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করে।
তাঁর খিলাফতের প্রথম পর্বে আরবের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কয়েক শ হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করেন। ওমর (রা.)–এর পরামর্শে হজরত আবু বকর (রা.) যায়েদ ইবনে সাবিতের নেতৃত্বে তখন একটি কমিটি গঠন করেন। সম্পূর্ণ কোরআন গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়। সেটি আবু বকর (রা.) নিজের কাছে রেখে দেন। কোরআনের সেই কপি মাসহাফে সিদ্দিকী নামে পরিচিত।
১৩ হিজরিতে ৬২ বছর বয়সে আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল করেন। রাসুল (সা.)–এর রওজা মোবারকের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post