বাংলাদেশের ইসলামি শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের একজন ছিলেন শাহ আহমদ শফী; যিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী বা আল্লামা শফী নামেও পরিচিত। বহুল চর্চিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও আমির ছিলেন তিনি। একইসঙ্গে ছিলেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। এছাড়া তিনি আল জামেয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসার (হাটহাজারী মাদ্রাসা নামে পরিচিত) মহাপরিচালক ছিলেন।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী আধুনিকোত্তর বাংলাদেশের সর্বাধিক পরিচিত একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ। তিনি ১৯২০ (উইকিপিডিয়া) সালে মতান্তরে ১৯১৫ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম বরকত আলী ও মায়ের নাম মরহুমা মেহেরুন্নেছা। ১০ বছর বয়সে তিনি আল্-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন।
আরো পড়ুনঃ কুরআন তেলাওয়াত শুনে জীবিত হলেন তিনি!
ওই বয়সে কিছুদিনের মধ্যে তিনি পিতা-মাতা উভয়কে হারান। এরপর একটানা ১০ বছর আল্-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় অতিবাহিত করেন। ২০ বছর বয়সে (১৯৪১ সালে) তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আলেমদের কাছে দূর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল এ মাদ্রাসাটি। ওই সময় তিনি শায়খুল আরব ওয়াল আজম, সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানীর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। অল্প সময়েই তিনি খেলাফতপ্রাপ্ত হন। তিনি তৎকালীন স্বীয় উস্তাদ মাদানী রহ. এর নেতৃত্বে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদেন।
আরো পড়ুনঃ অক্টোবর থেকে ওমানে নিয়মিত ফ্লাইট চালু করবে বিমান
কর্মজীবনে আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী একাধারে চার বছর অধ্যয়ন ও বিশ্ববিখ্যাত ধর্মগুরুদের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে হাদিস, তাফসির, ফিকাহশাস্ত্র বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি আল্লামা মাদানীর প্রতিনিধি হয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন। এরপর চট্টগ্রামে আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামে শিক্ষক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। ১৪০৭ হিজরিতে তিনি এর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও তিনি পালন করে গেছেন।
বাংলাদেশে আল্লামা শফীর প্রভাব : বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রভাব রাখা আলেমদের একজন ধরা হয় আল্লামা শফীকে। দেশে অনসৈলামিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ও নাস্তিকদের শাস্তির দাবিতে তাঁর ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রভাব তৈরি করে।
এছাড়াও ভারতে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ, ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের প্রতিবাদ, তাসলিমা নাসরীন খেদাও আন্দোলনসহ সরকারের ফতোয়া বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে তৎকালীন সময়ে আল্লামা শফি ছিলেন প্রথম সারিতে।
তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলী :
উর্দূ
• ফয়জুল জারী (বুখারীর ব্যাখ্যা)
• আল-বায়ানুল ফাসিল বাইয়ানুল হক্ব ওয়াল বাতিল
• ইসলাম ও ছিয়াছাত
• ইজহারে হাকিকাত
বাংলা
• হক ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব
• ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা
• ইসলাম ও রাজনীতি
• সত্যের দিকে করুন আহবান
• সুন্নাত ও বিদ’আতের সঠিক পরিচয়
আল্লামা শফীর জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে। রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায় পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসা এবং হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার পর ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসাতেও চার বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন তিনি। এরপর থেকে টানা ৩৪ বছর ধরে তিনি ওই পদে ছিলেন।
বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে অসুস্থ হয়ে পড়েন আল্লামা শফী। রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মেডিকেল বোর্ডে বসেন। শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় বিকেলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আল্লামা শাফী ২০০৯ সালে আজিজুল হক ও অন্যান্য সিনিয়র ইসলামী ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন যেখানে, ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যক্রমের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। ২০১০ সালে তিনি হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলায় ১৩টি ও উর্দুতে নয়টি বইয়ের রচয়িতা তিনি। আলেমদের বড় একটি পক্ষের কাছে খুব শ্রদ্ধার পাত্র। তবে নারীবিরোধী নানা বক্তব্যের জন্য বিভিন্ন সময় হয়েছেন সমালোচিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে তিনি বেশি আলোচনায় আসেন। ২০১৭ সালে তার সঙ্গে বৈঠকের পর কওমির সনদের স্বীকৃতি এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভাস্কর্য অপসারণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে কওমি মাদ্রাসাগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন আহমদ শফী, যাদের কাছে তিনি ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত। তিনি কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতি ছিলেন।
দেশের এই প্রখ্যাত আলেমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) পৃথক শোক বার্তায় তারা সমবেদনা জানান। শোক বার্তায়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
আরো দেখুনঃ ওমানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post