২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সামসুদ্দিন তালুকদারের জীবনাবসান ঘটে। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিকির শ্বশুর ছিলেন। তাঁকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। ডিএনসিসির কবরস্থানবিষয়ক নীতিমালা অনুযায়ী, সাধারণ এলাকায় দাফন করা কবর নির্ধারিত ফি ছাড়া সংরক্ষণযোগ্য নয়। তবে কবরটি সংরক্ষণ ও পাকাকরণে এ নীতিমালা মানা হয়নি।
শুধু সচিব মাসুদ আলমের শ্বশুরের ক্ষেত্রে নয়, সিটি করপোরেশন আর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার স্জনের বেলায়ও ঘটেছে এমনটি। গত বুধবার (২০ ডিসেম্বর) করপোরেশনের ২৪তম সভায় স্থায়ীভাবে কবর সংরক্ষণ অনুমোদন পাওয়া ১৭টি কবরের মধ্যে সাতটিতে হয়েছে এমন অনিয়ম। এতে সিটি করপোরেশন কবরপ্রতি সর্বনিম্ন ২০ লাখ থেকে সাড়ে চার কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হারিয়েছে।
ডিএনসিসির কবরস্থানবিষয়ক নীতিমালায় বলা হয়েছে, শুধু মেয়রের অভিপ্রায় এবং সরকারের নির্দেশনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বরেণ্য ব্যক্তির কবর সাধারণ এলাকায় হলেও সংরক্ষণ করা যাবে। অন্য ক্ষেত্রে ১৫ অথবা ২৫ বছরের কবর সংরক্ষণ ফির তিন গুণ পরিশোধ করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর ১০ বছর পর্যন্ত ফি ছাড়াই সংরক্ষণ করা যাবে। পরবর্তী সময়ে তাদের কবরেও নির্ধারিত ফি গুনতে হবে।
ডিএনসিসির কবর মেয়াদি সংরক্ষণ ও পাকাকরণ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। আমরা কবর স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে সাধারণ এলাকার কবর সুপারিশ করি না। এ রকম ঘটার সুযোগ নেই। মেয়রের কাছে কবর সংরক্ষণের আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই কমিটি পর্যালোচনা করে বোর্ড সভায় উপস্থাপন করেছে। বোর্ড সভায় অনুমোদন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানোর পর সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন,
“মৃত ব্যক্তিকে পুঁজি করে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের এ সুবিধা নেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরাসরি দুর্নীতি। সিটি করপোরেশনের কবরস্থান রাষ্ট্রের ও জনগণের সম্পদ। কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তাদের স্বজনের জন্য এ ধরনের সুবিধা নিতে পারেন না।”
এটিও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের মধ্যে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কাজটি যারা করেছেন তারাসহ সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিরাও দায়ী। কারণ তারা এ অপকর্মকারীদের সুরক্ষা দিচ্ছেন। করপোরেশনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের উচিত এই দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অসৎ সুবিধা কেউ নিতে না পারে।
ডিএনসিসির সমাজকল্যাণ বিভাগ জানায়, আগে ১০, ১৫, ২০, ২৫ বছর পর্যন্ত কবর সংরক্ষণ করার সুযোগ ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কবরস্থান নীতিমালা-২০২২ অনুমোদন হয়। এতে ১৫ অথবা ২৫ বছর মেয়াদে কবর সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। ডিএনসিসির ছয়টি কবরস্থানের মধ্যে বনানী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি ১ কোটি টাকা আর ২৫ বছরের জন্য দেড় কোটি টাকা, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরের সংরক্ষণ ফি ৭৫ লাখ আর ২৫ বছরের জন্য ১ কোটি টাকা।
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১৫ বছরে ৫০ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ৭৫ লাখ টাকা ফি ধরা হয়েছে। উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে এটি ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৩০ লাখ ও ৫০ লাখ টাকা, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ২০ লাখ টাকা আর ২৫ বছরের জন্য ৩০ লাখ টাকা এবং রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ১০ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ১৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিনা ফি অথবা প্রতীকী মূল্যে কবর সংরক্ষণের জন্য আবেদন যাচাই-বাছাই করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থানের সংরক্ষিত এলাকায় করপোরেশনের অঞ্চল-৩-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জুলকার নায়নের ছেলে আব্দুল্লাহকে দাফন করা হয়। গত বুধবার (২০ ডিসেম্বর) সিটি করপোরেশনের বোর্ড সভায় ওই কবরটি ১ হাজার ১ টাকা প্রতীকী মূল্যে সংরক্ষণ ও পাকা করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ দিন বোর্ড সভায় ১৭টি কবরের মধ্যে ২০১১ সালের ২২ আগস্ট মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের সংরক্ষিত এলাকায় দাফন করা করপোরেশনের অঞ্চল-৫-এর সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ বেলায়েতের ভাইয়ের স্ত্রী ফারহানা হায়াত চৌধুরীর কবরটি বিনা ভাড়ায় ২৫ বছর, ২০২২ সালের অক্টোবরে রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানের সংরক্ষিত এলাকায় সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব আবদুল মতিনের স্ত্রী রেহেনা বানুর কবর প্রতীকী মূল্যে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের সাধারণ এলাকায় সাংবাদিক নাজনীন আখতারের মেয়ে মায়াবী মাহভাসের কবর ১৫ বছর প্রতীকী মূল্যে, ২০২০ সালের আগস্টে বনানী কবরস্থানের নতুন সাধারণ এলাকায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিকুর রহমান আতিকের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের কবরটি বিশেষ বিবেচনায় ও ছাড়ে।
২০২৩ সালের আগস্টে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থানের সংরক্ষিত এলাকায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের স্ত্রী সাবেক যুগ্ম সচিব নাসরীন মুক্তির কবরটি ২৫ বছর মেয়াদে বিনামূল্যে সংরক্ষণ ও পাকাকরণ, ২০২১ সালে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানের সংরক্ষিত এলাকায় সরকারের সাবেক কর্মকর্তা শাহীন আরার কবরটি বিশেষ বিবেচনায় বিনামূল্যে সংরক্ষণের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়।
ডিএনসিসির ‘কবর মেয়াদি সংরক্ষণ ও পাকাকরণ সংক্রান্ত কমিটির’ এক সদস্য বলেন, সিটি করপোরেশনের সচিব, নির্বাহী কর্মকর্তা, সরকারের সাবেক সচিব ও প্রভাবশালীদের সুপারিশে এ তালিকা যাচাই-বাছাই করে করপোরেশনের বোর্ড সভায় পাঠানো হয়েছে। এ তালিকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও অনুমোদন পাবে।
এ বিষয়ে কবর মেয়াদি সংরক্ষণ ও পাকাকরণ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিকি গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় অনেকেরই কবর সংরক্ষণের সামর্থ্য নেই। তিনি নিজেও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর শ্বশুরের কবর সাধারণ এলাকায় দাফন করা হয়েছিল। এখন তিনি ১৫ বছরের জন্য ফি ছাড়া কবর সংরক্ষণের আবেদন করেছেন। আরও অনেকের স্বজনের কবর সংরক্ষণের আবেদন করা আছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post