বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নতুন উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি একটি বিলাসী সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলছেন, এটি কোনো বিলাসী সিদ্ধান্ত নয়, বরং ব্যবসায়িক প্রয়োজন।
বিমানের নতুন চালু হওয়া টরন্টো রুট জনপ্রিয় হয়েছে এবং আগামী মার্চ থেকে বিমানের ফ্লাইট রোমেও যাবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, কোম্পানি এ বছরও লাভের মুখ দেখবে। বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম জার্নালিস্টস ফোরাম বাংলাদেশ আয়োজিত ‘এটিজেএফবি ডায়ালগ’ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সটির এমডি ও সিইও শফিউল আজিম।
বিমানের ট্রেইনিং সেন্টারে আয়োজিত এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এটিজেএফবি এর সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক সবুজ; সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি তানজিম আনোয়ার। সম্প্রতি বিমানের বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করার আলোচনা চলছে।
বিশ্বের প্রধান দুটি উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িং ও এয়ারবাস এ নিয়ে আগ্রহী জানিয়ে বিমানের এমডি বলেন, “আমাদের সক্ষমতা আছে জেনেই তারা আমাদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। উভয়ের প্রস্তাবই আমাদের টেবিলে রয়েছে। যার কাছ থেকে ভালো দামে পাব, যারা বেশি সুযোগ-সুবিধা দেবে, যেখানে গেলে আমাদের বেশি লাভ হবে আমরা তার কাছেই যাব।”
সম্প্রতি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বোয়িংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে বিমানের এমডির সঙ্গে দেখা করেছেন। এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে শফিউল আজিম বলেন, “তারা এসেছিলেন। আমরা আলোচনা করেছি। এয়ারবাসের সঙ্গেও আমাদের আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। যার প্রস্তাব বেশি ভালো, আমরা তার সঙ্গেই গ্রাহক হিসেবে ব্যবসা করতে চাইবে।”
দেশের অর্থনীতির নাজুক দশার মধ্যে মোটা অর্থ ব্যয়ে নতুন উড়োজাহাজ কেনা বিলাসী সিদ্ধান্ত কী না– এমন প্রশ্নে বিমানের এমডি বলেন, “সেই অর্থে ধরলে এয়ারলাইন্স হচ্ছে একটা লাক্সারি বিজনেস। এখানে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়। উড়োজাহাজ কেনা যদি লাক্সারি হয়, সেটা বিজনেসের জন্যই, আমার তো টাকা আসছে। আমার যদি মার্কেট ডিমান্ড করে এবং আমার যদি ক্যাপাসিটি থাকে, তাহলে কেন নয়।
“আমি তো বিমানের ইনকাম দিয়েই নতুন এয়ারক্রাফট কিনছি। আমাদের এখন যে ড্রিমলাইনারসহ অন্যান্য এয়ারক্রাফটগুলো চলছে, এগুলোর কিস্তির টাকা কিন্তু বিমান ঠিকমতই দিচ্ছে, এক ঘণ্টার জন্যও ডিফল্ট করে নাই। আমাকে কম্পিটিশন করতে হয় এমিরেটসের সাথে, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সাথে, কাতারের সাথে। আমি তাদের চেয়ে কোন অংশে কম আছি? আমাকে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে গেলে তো নতুন উড়োজাহাজ লাগবেই । আর্থিক সক্ষমতা, অন্যান্য ক্যাপাসিটি না থাকলে তো আমি নতুন কেনার কথা বলব না।”
শফিউল আজিম বলেন, “আমার তো ডিমান্ড আছে। আমি যদি এটা ধরতে না পারি, তাহলে তো অন্যরা এসে দখল করবে। বিমানকে দুর্বল বা নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার পেছনে রয়েছে অন্য বড় বড় প্লেয়ার, এটা তাদের একটা স্ট্র্যাটেজি। অথচ আমরা যাত্রী বহনে এখন থ্রি মিলিয়ন ক্লাবে আছি। বছরে ৩২ লাখ যাত্রী বহন করছি আমরা। এটা আগে কখনো হয়নি। কোম্পানি হিসেবে আমরা বিলিয়ন ডলার ক্লাবের মেম্বার। বাংলাদেশের এভিয়েশনের যে গ্রোথ, সেটা পৃথিবীর অন্য কোনো অংশের চেয়ে বেশি। আমাদের শক্তি হচ্ছে আমাদের প্রবাসীরা। আর এই মার্কেট অন্যরা দখলে নিতে চায় বলে বিমানের বিরুদ্ধে এত কথা।”
তবে ইউরোপে বিমানের ফ্লাইট নিয়ে যে ‘অপূর্ণতা’ রয়েছে, সে কথা স্বীকার করেন এমডি। তিনি বলেন, “আমাদের টরন্টো ফ্লাইটটা ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছে। আগামী মার্চ থেকেই ইতালির রোমে ফ্লাইট যাবে। সরাসরি যাবে, না মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে একটা বিরতি দিয়ে যাবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
“কুয়েতে একটা বিরতি দিয়ে গেলে বেশি লাভ হবে না সরাসরি গেলে তা যাচাই চলছে। কুয়েতে বিরতি দিয়ে গেলে ঢাকা থেকে কুয়েতের যাত্রীও বহন করা যাবে। তবে কুয়েত থেকে কোনো যাত্রী তোলা যাবে না। কারণ কুয়েতের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘ফিফথ ফ্রিডম’ চুক্তি নেই। আড়াইশ থেকে ২৭০ আসনের বোয়িং ড্রিমলাইনার দিয়ে রুটটি চালানো হবে। সরাসরি ঢাকা থেকে রোম যেতে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা লাগবে।”
ঢাকার পাশাপাশি সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু করার কথাও বলেন বিমানের এমডি।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকে সিলেট বা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে যে ফ্লাইটগুলো যাচ্ছে, তাতে উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের সাইকেল নষ্ট হচ্ছে। সিলেট ও চট্টগ্রামে গাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্টগুলোও চলে গেছে। ঢাকার পাশপাশি সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকেও ফ্লাইটের খাবার (ক্যাটারিং) সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্রুরাও সিলেট ও চট্টগ্রামেই থাকবেন।
বিমানের গ্রাহক হিসেবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা তুলে ধরে শফিউল আজিম বলেন, “তারাই আমাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। আমি ক্রুদের বলে দিয়েছি, যারা প্রবাসীদের ঠিকমত সেবা দেবে না, খারাপ আচরণ করবে, তারা বিমানের চাকরি করতে পারবে না।” মধ্যাপ্রাচ্য থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটগুলোর বিজনেস ক্লাস বেশিরভাগই ফাঁকা থাকে বলে জানান কোম্পানির এমডি। বিজনেস ক্লাসে যাত্রী পেলে ইকোনমি ক্লাসের ভাড়া আরও কমানো সম্ভব হত বলে তিনি জানান।
শফিউল আজিম বলেন, “বিমান তো একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। ব্যবসা করেই টিকে থাকতে হবে আমাদের। তাই অনেক চেষ্টা করেও ভাড়া বাজেট এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে টিকিটের দামে আমরা কুলিয়ে উঠতে পারি না। তারা অনেক কিছুতে কাটছাঁট করতে পারে, এমনকি ফ্লাইটে এক গ্লাস পানিও দেয় না। কিন্তু বিমানের ফ্লাইটে গ্রাহকদের পেটভরার মত খাবার সরবরাহ করা হয়।”
এরপরও ‘এক শ্রেণির মধ্যবিত্ত’ বিমানের প্রতি নেতিবাচক মানসিকতা পোষণ করেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেকে যারা একটু ভালো চাকরি করে, তাদের অনেকেই বিমানের বিষয়ে অনেকটা উন্নাসিক। তাদের ভাব এমন যে বিমানে কেবল প্রবাসী শ্রমিকেরাই চড়বেন।
“তবে আমরা বলতে চাই, অন্যদের যা আছে, আমরাও সেটা দিচ্ছি। আমাদের এয়ারক্রাফটগুলো নতুন, খাবার ভালো। আর ইনফ্লাইট আচরণ নিয়ে কোনো অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থাই নয়, যারা অপরাধ করছে, তাদের থানা-পুলিশের ধরিয়ে দিয়ে আমরা একটুও দেরি করছি না।”
চলতি বছর বিমান লাভের মুখ দেখবে– এমন আশা প্রকাশ করে এমডি বলেন,
“এ বছর ডলারের দামে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় বিমান শুধু এক্সচেঞ্জ লস করেছে ১৪০০ কোটি টাকা। এরপরেও বিমান এ বছর লাভের মুখ দেখবে। এখন অডিট চলছে। অডিট রিপোর্ট তৈরি হলে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।”
বিমান ভালো করুক এটা ‘একটা শ্রেণি চায় না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তাদের দাবি ছিল ডোমিস্টিকে যেন বিমান ফ্লাইট না চালায়। ডোমিস্টিক রুটগুলোতে বিমান ফ্লাইট চালায় বলে ভাড়া একটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। না হলে তারা তা বাড়িয়ে দিত। “কারও কথায় বিমান থামবে না। বিমান এগ্রেসিভলি ফ্লাইট চালাবে, এগ্রেসিভলি মার্কেটিং করবে। এটা জনগণের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমাদের ব্যবসার কথাও মাথায় রাখতে হয়।”
বিমানের বহরে ২১টি উড়োজাহাজের মধ্যে লিজে আনা দুটি উড়োজাহাজও সম্প্রতি বিমান কিনে নিয়েছে বলে জানান শফিউল আজিম।
তিনি বলেন, “আমরা এখন নো লিজ পলিসি নিয়েছি। আমাদের একটা ড্যাশ-৮ ছিল। ওটার লিজের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। লিজের শর্ত থাকে যে অবস্থায় উড়োজাহজ নিয়ে আসা হয়েছিল সেই অবস্থাতেই ফেরত দিতে হবে। হিসেব করে দেখা গেল, তার চেয়ে কিনে নেওয়াই ভালো। আর অনেক ভালো দরে উড়োজাহাজটি কিনে নিয়েছে বিমান। পরে এটি বিমানের নিজস্ব প্রকৌশলীরাই সার্ভিস করেছে, এখানেই এটি রঙও করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই সেটি সার্ভিসে নামবে।”
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইজিপ্ট এয়ারের দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার ঘটনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ২৩ কর্মকর্তা ও কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, এই লিজ চুক্তির মাধ্যমে সরকারের ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post