যুক্তরাজ্যের ডাম্বল ফার্ম নামে একটি গরুর খামারের ব্যবসার লোকসান ঠেকাতে একটি অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে। যা দেশটিতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফার্মের মালিকরা কাডলিং সেশন নামে গরুকে জড়িয়ে ধরার একটি সেশন চালু করেছে, যা মানুষের মানসিক চাপ কমাতে থেরাপির মতো কাজ করে।
পশু প্রেমীদের কথা মাথায় রেখে নতুন এ উদ্যোগটি শুরু করে তারা। দেখেছে সফলতার মুখও। জনপ্রতি সেশন ফি টিকিট প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকা, যা কয়েক মাস আগেই অগ্রিম বিক্রি হয়ে যায়। রবিবার ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে।
মোরাগ, স্কটিশ হাইল্যান্ড জাতের একটি আকর্ষণীয় গরু। উত্তর ইংল্যান্ডের ডাম্বল ফার্মের প্রধান ঘর থেকে মাত্র বেরিয়ে এসেছে। অতিথিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রস্তুত সে। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা পূর্ব ইয়র্কশায়ারের বেভারলির কাছে অবস্থিত এই খামারে দুধ, দই বা পনির কিনতে নয়, এসেছেন মোরাগ এবং তার সঙ্গীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
আধুনিক ডেইরি ফার্ম পরিচালনায় অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় ফিওনা উইলসন এবং ডাম্বল ফার্মে তার অন্যান্য সহকর্মীরা ফেব্রুয়ারিতে কাডলিং বা আলিঙ্গন সেশন শুরু করেছিলেন। এএফপিকে উইলসন বলেন, ‘কিছু মানুষ কুকুর, বিড়াল বা ঘোড়ার সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন এবং অন্যরা ভালোবাসেন গরুর সঙ্গে সময় কাটাতে। মানুষ একটি ভালো উদ্দেশ্যে এখানে আসছেন। মানুষের মানসিক উদ্বেগ কমাতে প্রাণীদের সাহচর্য প্রায় একটি থেরাপির মতো কাজ করে।’
‘এভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব’
ডাম্বল ফার্মের মালিকরা তাদের খামার ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছিলেন। কেননা, দুধের দামে তীব্র পতন এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি তাদের দুগ্ধ খামার ব্যবসাকে প্রায় পঙ্গু করে দিচ্ছিল। গত কয়েক দশক ধরে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কৃষকদের এই খামার শিল্প ছেড়ে বিকল্প আয়ের পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে। হাউস অব কমন্স লাইব্রেরির একটি গবেষণার সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে বলা হয়েছে, ১৯৫০ সালে যুক্তরাজ্যে এক লাখ ৯৬ হাজার দুগ্ধ খামার ছিল। ১৯৯৫ সাল নাগাদ এ খামারের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩৫ হাজার ৭০০টিতে।
২০ মাস আগে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে একদিকে যেমন দুধের দাম কমে যায় তেমনি অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান বিদুৎ ও জ্বালানি, পশু খাদ্য এবং সারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকের জন্য তাদের কফিনের শেষ পেরেকের মতো ঠেকেছে। কৃষকদের প্রতিনিধিত্বকারী ‘কৃষি ও উদ্যান উন্নয়ন বোর্ডে’র প্রধান দুধ ক্রেতাদের নিয়ে করা সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্রিটেনে আনুমানিক ৭ হাজার ৫০০টি দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামার ছিল।
সমসাময়িক বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেই ডাম্বল ফার্ম গত সাত বছরের মধ্যে ছয় বছরই বন্যার কবলে পড়ে। সেসময় প্রতি বছরই খামারটি কয়েক মাস ধরে পানির নিচে ছিল।
উইলসন বলেছিলেন,
তিনি এবং তার খামারের অংশীদাররা, যাদের মধ্যে তার স্বামী এবং ভাইও রয়েছেন; তারা বছরের প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করছিলেন এবং একইসঙ্গে লোকসানের মুখে পড়ছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘এভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব। এখানে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের অবস্থার কোনও উন্নতিই হচ্ছিল না।’ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে কৃষকরা তাদের দুগ্ধ খামারে বৈচিত্র্য আনার সিদ্ধান্ত নেন এবং পাঁচটি গরু ছাড়া বাকি সব দুগ্ধজাত পশুগুলো বিক্রি করে দেন। ওই পাঁচটি গরুর সঙ্গে তাদের বেশ ভাব ছিল।
উইলসন বলেছিলেন,
‘এরা শান্ত ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রকৃতির। এরা সত্যিই আমাদের বন্ধু ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভাবলাম, আমাদের সংরক্ষণ প্রকল্পের বাইরে গরুগুলো ব্যবহার করে কাডলিং সেশনের মাধ্যমে কিছুটা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে পারি। এবং এই আইডিয়া শেয়ার করে অন্যান্য মানুষদেরকেও আমরা তাতে জড়িত করছিলাম। সেবাগ্রহীতাদের আমন্ত্রণ জানাতে এবং তাদের আলিঙ্গন করতে গরুগুলো কয়েক মাস ধরে প্রস্তুত করা হয়।
উইলসন বলেছিলেন, ‘এরা বেশ উৎসুক প্রাণী। মানুষ এদের কাছে আসলে বেশ আগ্রহ দেখায় এরা।’ তাদের এই উদ্যোগ দেশব্যাপী বেশ সাড়া ফেলে। নতুন এ অভিজ্ঞতা নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গরু প্রেমিরা পরিবারসহ এখানে বেড়াতে আসে। জনপ্রতি প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকা মূল্যের টিকিট কয়েক মাস আগেই অগ্রিম বিক্রি হয়ে যায়।
‘এই অভিজ্ঞতা—দারুণ একটা থেরাপি’
শস্যাগারের ভেতরে ঘুমন্ত গরুগুলো জাবর কাটে। এদের চিবুকের নরম পশমে হাত বুলিয়ে আনন্দ পায় দর্শনার্থীরা। স্টিভেন ক্লুস বলেছিলেন, তার স্ত্রীর জন্য তিনি এই সেশনের একটি টিকিট কিনেছিলেন। যিনি হাইল্যান্ড জাতের গবাদি পশু বেশ পছন্দ করেন। ক্লুস বলছিলেন, ‘আমি সব প্রাণীর প্রতি অনুরাগী, তবে বিশেষ করে যারা আলিঙ্গন করতে ভালোবাসে। তাই এত বড় একটি প্রাণীকে আলিঙ্গন করতে পারাটা আমার জন্য সত্যিই দুর্দান্ত একটি অভিজ্ঞতা।’
তার স্ত্রী এমা ক্লুস বলেছেন, ‘তাদের ব্রাশ করা খুবই সহজ। প্রথমে আমার মনেই হয়নি এটি আমার কাছে প্রশান্তির মনে হবে। তবে এরা খুবই আদুরে। এই অভিজ্ঞতা—দারুণ একটা থেরাপি।’
অধিবেশন শেষ হলে, দর্শনার্থীদের গোয়ালঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রোদের আলোয় মোরাগ অপেক্ষা করে। দর্শকরা তার নরম লোমশ বুকে হাত বুলিয়ে আদর করলে মোরাগ আকাশের দিকে তার মাথা বাড়িয়ে দেয়। মানব সঙ্গীদের কাছ থেকে পাওয়া এই আদরে ওর মুখে তৃপ্তির হাসি এবং আনন্দ ফুটে ওঠে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post