ক্রমেই বাড়তে থাকা ডলারের দর ১০ দিনের ব্যবধানে দুই বারে ৭৫ পয়সা কমানোতে মুদ্রাবাজারে কিছুটা স্বস্তি আসবে বলে যে দাবি করা হয়েছিল, সেটি পুরোপুরি হয়নি। এখনও গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না বলে বাড়তি দরেই রেমিটেন্স আনছে ব্যাংকগুলো।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বলছে, নির্ধারিত দর অনুযায়ী রেমিটেন্স পাচ্ছে না তারা। যে কারণে বাড়তি দরে কিনতে হচ্ছে। আন্তঃব্যাংকে ঘোষিত যে দর রয়েছে সে দরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রধান এ মুদ্রা বিক্রি করছে না কেউ; খোলাবাজারে দাম আরও বেশি, যদিও সেখানে উত্তাপ আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে বলে আমদানিকারকদের কাছ থেকেও ব্যাংকগুওলোকে দর বেশি নিচ্ছে।
যেসব ব্যাংক বেশি দরে ডলার কিনছে, সেগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় বলে আসছে নির্ধারিত দরেই ডলার কেনার কথা। এজন্য সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে বিদেশি মানি এক্সচেঞ্জ হাউস ও খোলা বাজারে ডলার লেনদেনকারি মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করেছে তারা।
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমার কথা জানিয়ে গত ২৩ নভেম্বর প্রথমবারের মতো ডলারের দর কমানো হয় ৫০ পয়সা। ছয় দিন পর দর কমানোর ঘোষণা আসে আরও ২৫ পয়সা। দুই ধাপে ৭৫ পয়সা কমিয়ে ডলারের ক্রয় দর ঠিক হয় সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা এবং বিক্রয় দর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। এ দর কার্যকর হওয়ার কথা ৩ ডিসেম্বর থেকে। কিন্তু কোথাও এ দরে ডলার পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দর কমানো হলেও ডলারের সরবরাহ সংকট দ্রুত কাটবে তা মনে করেন না বেসরকারি ব্যাংক মিউচুয়াল ট্রাস্টের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন,
‘‘দাম কমানোর প্রভাব জানতে আরও সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। লেনদেন করতে পারলে জানা যাবে। আরও কয়েকদিন আগের রেটেই লেনদেন করতে হবে।’’
চাহিদার অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় ব্যাংকগুলো ১২২ টাকা দরেও প্রবাসী আয়ের ডলার কিনছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
সৈয়দ মাহবুবুর বলেন, “অনেক ব্যাংক এখনও ১২২-২৩ টাকায় রেমিটেন্স নিচ্ছে। কারণ হচ্ছে তাদের তো কিছু কমিটমেন্ট আছে। নতুন দরের বিষয়ে রোববার দিন শেষে জানা যাবে রেমিটেন্স কত দরে কেনা হচ্ছে।’’
বৈদেশিক মুদ্রা বাজার অস্থির হয়ে উঠার পর ২০২২ সালের জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বাজারমুখী করতে ডলারের দর নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনকে (বাফেদা) দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর পর থেকে সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে ডলারের দর নির্ধারণ করে আসছে সংগঠন দুটি। কিন্তু তাদের নির্ধারিত দরে ডলার কেনাবেচা হয়েছে খুব কম সময়েই। নভেম্বরে রেমিটেন্স এল ১৯৩ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি ২১%
রেমিটেন্স পাঠালে ভালো দর পাচ্ছেন প্রবাসীরা
সরকার রেমিটেন্সের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়। বাফেদা ও এবিবি এর বাইরে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারবে। ডলারের বিনিময় হারের বর্তমান দর অনুযায়ী, এ হিসাবে রেমিটেন্সের ডলার ১১৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
আরব আমিরাতে থাকা প্রবাসী হাসান আহমেদ জানান, সম্প্রতি তিনি ১২২ টাকা ৯২ পয়সা দরে একটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন হয়ে বাংলাদেশে ৩৫ হাজার টাকা পাঠাতে এ প্রবাসীকে কুয়েতের ব্যাংকে জমা দিতে হয়েছে ৮৭ দশমিক ৮৮ দিনার। প্রতি দিনারের বিপরীতে টাকার দর ছিল ৩৯৮ টাকা ২৭ পয়সা।
দেশে থাকা তার স্বজন বেসরকারি একটি ব্যাংকের হিসাবে ৩৫ হাজার টাকার সঙ্গে সরকারি আড়াই শতাংশ প্রণোদনার বিপরীতে পেয়েছেন আরও ৮৭৫ টাকা। ১২২ টাকা ৫০ পয়সা দরে রেমিটেন্স পাঠানোর কথা জানিয়েছেন সৌদি আরবের দাম্মামে থাকা প্রবাসী আবেদ সরকার। সেখানকার আলিনমা ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গত বৃহস্পতিবার দেশে স্বজনের হিসাবে টাকা এসেছে। ডলারের বিপরীতে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা করে পেয়েছেন তার অনুমোদিত ব্যক্তি।
আরেক প্রবাসী শরিফ তালুকদার ইউনাইটেড আরব আমিরাতের দুবাই থেকে ৩৩ টাকা ৬৫ পয়সা দরে দিরহাম পাঠিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংক প্রতি ডলারে তিন দশমিক ৭৬ দিরহাম হিসেবে দর দিয়েছে ১২৩ টাকা ৪৯ পয়সা।
প্রবাসীরা জানিয়েছেন,
মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বা অ্যাপের মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোর সময়ই জানা যায় কত টাকার পাঠানোর বিপরীতে কত বিদেশি মুদ্রা জমা দেওয়া লাগবে। দর জেনে ও লেনদেন মাশুলসহ সেই অর্থ জমা দেন তারা।
ডলারের এ বাড়তি দর সদ্যসমাপ্ত নভেম্বরেও রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বগতির ধারা বজায় রাখতে সহায়তা করেছে। আগের কয়েক মাসের চেয়ে বেশি দর পাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হয়েছেন প্রবাসীরা। যে কারণে নভেম্বর শেষে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১৯৩ কোটি ডলার, আগের বছরের একই মাসের চেয়ে যা ২১ শতাংশ বেশি।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে রেমিটেন্স বেশি এসেছে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। ২০২২ সালের নভেম্বর শেষে রেমিটেন্স প্রবাহ ছিল ১৫৯ কোটি ৫১ লাখ ডলার। শুধু একক মাস নয়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। এই পাঁচ মাসে তারা পাঠিয়েছেন ৮৮১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বলেন, ‘‘বাফেদা-এবিবি যে দর ঠিক করে দিচ্ছে ওই দরে তো রেমিটেন্স পাচ্ছে না অনেক ব্যাংকই। কিছু ব্যাংক বেশি দিয়েও কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
‘‘ব্যাংকের তো আমদানি দায় পরিশোধের কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) আছে বিদেশের কাছে। তাদের তো ডলার দিতে হবে। এজন্য অনেকেই বাধ্য হয়ে ১২১-১২৩ টাকা দরেও ডলার কিনছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘নতুন দরে যদি ডলার না পাওয়া যায় তাহলে আমরা আবার বসব।” নির্ধারিত দরে না পেলে ডলার কেনা আপাতত বন্ধ রাখার কথাও জানিয়েছেন এই ব্যাংকার।
চাহিদা অনুযায়ী কি দিতে পারছে ব্যাংক, দর কত?
রোববার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও রূপালী ব্যাংক নগদ ডলার বিক্রি করেছে ১১৪ টাকায়। এর সঙ্গে ২৫০ টাকা মাশুল ফি নিচ্ছে পাসপোর্টে এনডোর্স করতে। বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক এদিন ডলার বিক্রি করেছে ১১৫ টাকা ৫০ পয়সায়, তারা কিনেছে ১১৪ টাকা ৫০ পয়সায়।
আমদানি পর্যায়ে প্রধান এ বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক দর থাকার কথা জানিয়েছেন বহুজাতিক কোম্পানি বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী। চাহিদা মেটানোর মতো ডলারের সরবরাহ বাজারে নেই বলেও মনে করেন ব্যবসায়ীদের এই নেতা।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘‘বাজারে ডলারের মাল্টিপল রেট আছে। আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করছি আমদানি করতে গিয়ে। ১১১-১১২ টাকা থেকে ১১৫-১১৬ টাকা দরেই কিনতে হচ্ছে আমাদের।’’
তবে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা বলছেন, দুই দফায় দর কমানো হলেও চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে ব্যাংক বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে। ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে পারছেন না।
পোশাক খাতের কোম্পানি সনেট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের মহাব্যবস্থাপক গাজী মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘‘নিয়মিত যে ডলার লাগে তা রপ্তানি আয় থেকেই হয়ে যায় আমাদের। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ (মূলধনী যন্ত্রাংশ) আমদানি করার সময়ে অতিরিক্ত ডলার লাগে। তখন ব্যাংক থেকেই নিতে হয়। এখন তো সংকট রয়েছে ডলারের তাই ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আনা হচ্ছে কম।’’
কাতার বিশ্বকাপের অফিসিয়াল টি-শার্ট প্রস্তুতকারক কোম্পানিটির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘যতটুকু না আনতে পারলে সমস্যা হবে ক্যাপিটাল মেশিনারিজের ততটুকুই আনছি। তাতে বেশি দামে ডলার কিনতে হয়। বিভিন্ন ব্যাংক ১১৪ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে প্রতি ডলারে।’’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সার্বিকভাবে এলসি (ঋণপত্র) নিষ্পত্তির হার কমেছে আগের অর্থবছরের এ সময়ের চেয়ে ২৪ শতাংশ। অন্যদিকে শুধু মূলধনী যন্ত্রাংশ আনা কমেছে ৪১ শতাংশ।
খোলাবাজারে কিছুটা কমেছে উত্তাপ
বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্ত হল- আন্তঃব্যাংকে ডলারের যে দর নির্ধারণ করা থাকবে তা খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে সর্বোচ্চ দেড় টাকা বেশিতে। কাগজে কলমে তা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। মানি এক্সচেঞ্জগুলো একটি দর লিখে ঝুলিয়ে রাখে; কিন্তু সেই দরে আসলে ডলার পাওয়া যায় না।
মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হেলাল শিকদার বলেন, “নতুন দর অনুযায়ী খোলাবাজারে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার ক্রয় করবে ১১৪ টাকা ৭৫ পয়সায় ও বিক্রয় করবে ১১৬ টাকা ২৫ পয়সা দরে।” কিন্তু অনেক মানিচেঞ্জারই এ দর না পেয়ে আগের ক্রয় দর ১১৫ টাকা ও বিক্রয় দর ১১৬ টাকা ৫০ পয়সা টানিয়ে রেখেছে তাদের বোর্ডে।
তবে পল্টনের মানি এক্সচেঞ্জের বিক্রয় কর্মীরা জানান, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা এদিন ডলারের দর বেচা ১২২ টাকা ৫০ পয়সা এবং কেনা ১২১ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছেন। এ দর অবশ্য নভেম্বরে শুরুতে সময়ে ১২৫ টাকায় উঠেছিল।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post