সাহাবি শব্দটি আরবি। আভিধানিক অর্থ সঙ্গী, সাথি, বন্ধু, অনুসারী, সহচর, এক সাথে জীবন যাপনকারী অথবা সাহচর্যে অবস্থানকারী। ইসলামি পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর সঙ্গী-সাথীদের বুঝায়। রসুল সা. এর শ্রেষ্ঠ সাহাবিদের নিয়ে আজ কথা বলবো।
ইবনে হাজার ‘আল ইসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা’ গ্রন্থে সাহাবির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, সাহাবি সেই ব্যক্তি যিনি মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি ঈমান সহকারে তার সাক্ষাৎ লাভ করেছেন, ইসলামের ওপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।
হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেন, সাহাবি হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, এক বা দু’বছর মুহাম্মদের সা.-এর সাহচর্য অথবা তার সাথে দু’একটি গাযওয়া বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ। কিছু সংখ্যক উলামায়ে উসুল ও উলামায়ে ইলমুল কালাম-এর মতে, সাহাবি হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, রসুলুল্লাহর সা. দীর্ঘ সাহচর্য ও সুন্নাতে নববীর অনুসরণের ক্ষেত্রে তার পরিচিতি ও খ্যাতি। কেউ কেউ আবার বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন।
একদল আলিমের মতে যে ব্যক্তি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর এক নজর মুহাম্মদকে সা.কে দেখেছেন, তিনি সাহাবি। আর যিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে মুহাম্মদকে সা.কে দেখেছেন, তিনিও সাহাবি।
সাহাবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন চার খলিফা। ১. হযরত আবু বাকর সিদ্দীক রা.। ২. উমার বিন খাত্তাব রা.। ৩. উসমান বিন আফফান রা.। ৪. আলী বিন আবি তালিব রা.।
জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবি
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-মের বিশিষ্ট ১০ জন জান্নাতি সাহাবির নাম। পৃথিবীতেই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন বিশিষ্ট সাহাবি।
হযরত আবু বকর রা.
পূর্ণ নাম আবদুল্লাহ বিন আবি কুহাফা। তিনি আবু বকর সিদ্দিক রা. নামে পরিচিতি ছিলেন। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ সা. এর একজন প্রধান সাহাবি, ইসলামের সর্বপ্রথম খলিফা ও প্রথম মুসলিমদের মধ্যে একজন। এছাড়াও আবু বকর সিদ্দিক রা. নবী মুহাম্মদ সা.-এর শ্বশুর ছিলেন।
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা রা. এর পিতা আবু বকর সিদ্দিক রা.। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি সন্দেহাতীত অগাধ বিশ্বাসের জন্য তাকে সিদ্দিক (বিশ্বস্ত) উপাধি দেয়া হয়। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. মৃত্যুবরণ করার পরে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. এর ঘরে নবী মুহাম্মদ সা. এর পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়। যার ফলে আবু বকর রা. রসুলের কবরের সঙ্গী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন।
হযরত ওমর রা.
পূর্ণ নাম ওমর ইবনুল খাত্তাব। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও প্রধান সাহাবিদের অন্যতম একজন। ওমর রা. ছিলেন ইসলামি আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। তিনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-কে ‘আল ফারুক’ (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়। আমিরুল মুমিনিন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন নবী মুহাম্মদ সা.-মের শ্বশর ও উম্মুল মুমিনিন হাফসা রা. এর পিতা। হযরত হাফসা রা. প্রথম স্বামীর থেকে তালাক প্রাপ্তা হলে পিতা ওমর রা. ইদ্দত শেষ হবার পর আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-মের সাথে বিবাহ দেন।
হযরত উসমান রা.
পূর্ণ নাম উসমান ইবনে আফফান। তিনি ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা ও প্রথম দিকের ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম। ইসলাম গ্রহণ পর রসুল সা. কন্যা রুকাইয়্যার সাথে উসমান রা. এর বিবাহ দেন। হিজরির দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পরপর মদিনায় রুকাইয়্যা মারা যায়। এরপর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. তার দ্বিতীয় মেয়ে উম্মে কুলসুমের সাথে উসমান রা.কে বিয়ে দেন। আর এ কারণেই উসমান রা. তিনি মুসলিমদের নিকট জুন-নুরাইন বা দুই জ্যোতির অধিকারী হিসেবে খ্যাত ছিলেন।
হযরত আলী রা.
আলী ইবনে আবি তালিব। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ সা. চাচাতো ভাই ও জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ ন্যায়নিষ্ঠ খলিফা। হযরত আলী রা. মাত্র ৯ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ যিনি খাদিজাতুল কোবরা রা. ইসলাম গ্রহণের পরেই দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত তালহা রা.
তাহলে ইবনে উবাইদুল্লাহ। তিনি ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম আটজন ব্যক্তির অন্যতম এবং তিনি রসুলের ঘনিষ্ঠ সাহাবি ছিলেন। তিনি উহুদের যুদ্ধ ও উটের যুদ্ধে অংশগ্রণের কারণে অধিক পরিচিত ছিলেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তালহা রা. আবু বকর সিদ্দিক রা. আহ্বানে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
হযরত যুবাইর রা.
হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম। তিনি ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমান ও নবী মুহাম্মদ সা.-এর সাহাবি ছিলেন। তিনি একাধারে রসুল সা. এর ফুফাতো ভাই ও ভায়রা ছিলেন। তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তিনি ইসলামের গ্রহণের পর গুজব ছড়ালো যে অমুসলিমরা নবী মুহাম্মদ সা. কে হত্যা বা বন্দী করে ফেলেছে। এটা শুনে উন্মুক্ত তরবারি সাথে নিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুবাইর রা. সাথে সাথেই নবী মুহাম্মদ সা.-মের বাড়িতে যান। রসুল সা. এর সিরাত লেখকদের মতে এটি হলো প্রথম তলোয়ার যা নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য একজন বালক উন্মুক্ত করেছিল। তিনি ইসলাম গ্রহণের কারণে অনেক অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
হযরত আবদুর রহমান রা.
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ। তার ইসলাম গ্রহনের পূর্বের নাম ছিল আবদুল আমর (আমরের দাস)। ইসলাম গ্রহণের পরে রসুল সা. তার নাম রাখেন আবদুর রহমান (সবচেয়ে দয়াবানের দাস)। আবদুর রহমান ইবনে আউফ ইসলাম গ্রহণকারী আটজন ব্যক্তির অন্যতম এবং তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করা পনেরোজন মুসলিমের অন্যতম ছিলেন।
হযরত সাদ রা.
হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.। তিনি ছিলেন মহানবী মুহাম্মদ সা.-এর অন্যতম প্রধান সাহাবি। তিনি ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭তম ব্যক্তি ছিল। ৬৩৬ সালে পারস্য বিজয়ের নেতৃত্ব ও শাসনের জন্য তিনি অধিক পরিচিত পেয়েছিলেন।
হযরত সাইদ রা.
হযরত সাইদ ইবনে যায়িদ। তিনি ছিলেন খলিফা উমর রা. এর ভগ্নিপতি অর্থাৎ উমর রা. এর বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব এর স্বামী। সাইদ ইবনে যায়িদ রা. ছিলেন প্রাথমিক পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীদের সাহাবীদের মাঝে একজন।
হযরত আবু উবাইদাহ রা.
হযরত আবু উবাইদা আমর ইবনে আবদিল্লাহ ইবনুল জাররাহ। তিনি ছিলেন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন সাহাবী ও খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের সময় তিনি রাশিদুন সেনাবাহিনীর একজন সেনাপতি ছিলেন। রসুল সা. ইসলাম প্রচারের শুরুতে নিজের কাছের সঙ্গীদের প্রথম ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। তখন আবু উবাইদাহ রা. ইসলাম গ্রহণ করেন।
এছাড়াও সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের মধ্যে অন্যতম, হযরত আবু হুরাইরাহ রা.। প্রকৃত নাম আবদুর রহমান ৫৭ হিজরিতে তিনি ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি মোট ৫৩৭৪ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। এরপর সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন, উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা.। তিনি ৫৮ হিজরিতে ৬৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.। তিনি ৬৮ হিজরিতে ৭১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনিও বেশি হাদিস বর্ণনাকারী শ্রেষ্ঠ সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ১৬৬০টি হাদিস বর্ণনা করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.। তিনি ৭০ হিজরিতে ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি সর্বমোট ১৬৩০টি হাদিস বর্ণনা করেন। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা.। তিনিও হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ৭৪ হিজরিতে ৯৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৫৪০টি হাদিস বর্ণনা করেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post