শরীয়তপুরে দালাল চক্রের লোভের ফাঁদে পড়ে তিন তরুণ লিবিয়ায় মাফিয়াদের খপ্পরে পড়েছেন। ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দিয়ে দালাল চক্রের সদস্যরা তাদের লিবিয়ায় নিয়ে যান। সেখানে মাফিয়ারা তাদের আটকে রেখে নির্যাতন ও মুক্তিপণের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।
পুলিশ, ভুক্তভোগীদের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের মার্চে লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের উত্তর ভাষানচর এলাকার ফেরদাউস মাদবর, আল-আমিন ফকির ও নড়িয়া উপজেলার দক্ষিণ নড়িয়া এলাকার রাকিব খানের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয় স্থানীয় ‘দালাল চক্র’ হাবিবুল ব্যাপারী ও তাঁর ছেলে ছলেমান ব্যাপারী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আল-আমিন ও রাকিব সম্পর্কে ‘দালাল’ হাবিবুল ব্যাপারীর আপন ভাগ্নে। ভাগ্নেদের পরিবারের কাছ থেকেও জমি লিখে নেয় হাবিবুল। পরে প্রথমে তাঁদের লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখানে তাদের রিসিভ করে ‘মানব পাচারকারী চক্রের’ বাংলাদেশি দুই সদস্য মকবুল হোসেন ও মকুল। তাঁরা লিবিয়া থেকে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে দালাল চক্রের বাংলাদেশি সদস্যদের মাধ্যমে ফেরদাউস, আল-আমিন ও রাকিবের পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে মোট সাড়ে ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে দালাল হাবিবুল ও তাঁর সঙ্গীরা মিলে ওই তরুণদের মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়।
মাফিয়ারা তিন তরুণকে জিম্মি করে লিবিয়ার একটি স্থানে ১১ মাস আটকে নির্যাতন করে আরও ১৫ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর মাফিয়া চক্রের সদস্য মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা তুহিন ও তাঁর সঙ্গীরা বাংলাদেশে তাদের পরিবারকে মোবাইলফোনের মাধ্যমে ভিডিও কল করে জিম্মিদশা ও নির্যাতনের দৃশ্য দেখান। তারপর তুহিনের মামী বাংলাদেশের মনিরা বেগমের মাধ্যমে মুক্তিপণের ১১ লাখ টাকা করে পরিশোধ করে তিনটি পরিবার।
২০২২ সালের ৬ নভেম্বর আল-আমিন ফকিরের মা মঞ্জিলা বেগম বাদী হয়ে শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দালাল হাবিবুল ব্যাপারী গংদের নামে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলা এখনো চলমান। এই মামলায় হাবিবুল ব্যাপারী, মকবুল ও মনিরা বেগমকে গ্রেপ্তার করে জেলা কারাগারে পাঠায় পুলিশ। তারা সবাই জামিনে আছেন।
এদিকে মাফিয়া চক্র টাকা পেয়ে ওই তরুণদের লিবিয়ার পুলিশের হাতে তুলে দেয়। সেখানে দুই মাস তিন দিন থাকার পরে চলতি বছরের ২৮ নভেম্বর ফেরদাউস, ২৯ নভেম্বর রাকিব ও আল-আমিন দেশে ফেরেন। তাঁরা এখন অসুস্থ অবস্থায় শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ভুক্তভোগী রাকিব খান বলেন, ‘মামা হাবিবুল ব্যাপারী, তাঁর ছেলে ছলেমান ব্যাপারীরা আমাকে, আমার খালাতো ভাই আল-আমিন ও ভাগ্নে ফেরদাউসকে লিবিয়া দিয়ে ইতালি নেওয়ার কথা বলে দুই ধাপে ৩৩ লাখ টাকা নেয়। পরে তারা ইতালি না নিয়ে আমাদের মাফিয়াদের হাতে বিক্রি করে দেয়। মাফিয়ারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করলে আমাদের পরিবারকে মুক্তিপণ হিসেবে মাফিয়াদের আরও ৩৩ লাখ দিতে হয়।’
ভুক্তভোগী আল-আমিন ফকির বলেন, ‘মাফিয়ারা আমাদের প্রতিদিন দুইবার করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পেটাতো। আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গে দাগ হয়ে আছে। এছাড়া ওরা পানি ও খাবারেরও কষ্ট দিত। আমরা কখনো ভাবিনি যে বেঁচে দেশে মা-বাবার কোলে ফিরব।’
ভুক্তভোগী ফেরদৌস বলেন, ‘মাফিয়ারা ১১ মাস আমাদের বন্দী করে রেখেছিল। পরে টাকা পেয়ে লিবিয়ার পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ওইখানে দুই মাস তিনদিন থাকার পর বাংলাদেশের দূতাবাস আমাদের দেশে আনার ব্যবস্থা করে। দালালদের উপযুক্ত শাস্তি চাই আমরা। এমন ভুল পথে যেন বিদেশে কেউ না যায়।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল কাদের ফকির, ভুক্তভোগী পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী জানায়, ভুল পথে দালালদের মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে অসহায় তিনটি পরিবার জমি, বসতভিটা বিক্রি করেছে। তাছাড়া সুদ ও এনজিওর কাছ থেকে ঋণ এনে এখন পরিশোধ করতে পারছেন না। তাই দলালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারের সব অর্থ ফেরত দিতে হবে।
শরীয়তপুর সদরের আংগারিয়া ইউনিয়নে উত্তর ভাষানচর এলাকার দালাল হাবিবুল ব্যাপারীর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তাঁর ছোট ভাইয়ের ছেলের বউ হাজেরা আক্তার বলেন, ‘সত্য বলতেও কিছু না, মিথ্যা বলতেও কিছু না। সে (হাবিবুল) শুধু লিবিয়া নিয়ে দিছে। সে বিক্রিও করেনি, ইতালিও নিতে চায়নি। ইতালি তারাই দালাল ধরেছে এবং তারাই ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দিছে। রাকিব ও আল-আমিনের মা ফরাজের জমি আমার শ্বশুর ও চাচা শ্বশুরের কাছে চার লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন।’
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহবুবুল আলম, ‘এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার একটি মামলা দায়ের করেছে। যারা দোষী তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই মামলায় অতিদ্রুত দোষীদের আদালতে বিচারের সম্মুখীন করব। জেনেশুনে কিন্তু ওই তরুণ-যুবকেরা দালাল ও বিভিন্ন প্রতারকের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এই লোভ–লালসা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। সুতরাং এই অবৈধ পথ পরিহার করে, অবশ্যই সঠিক পথে, সঠিক ভিসা নিয়ে, সঠিক এজেন্সি ও স্কিল নিয়ে কাজের জন্য বিদেশ গমন করতে হবে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post