একজন বা দুজন নন, এক প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন সৌদি আরব প্রবাসী ১৩ হাজারের বেশি শ্রমিক। শপিংমলে দোকান দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন ওই প্রতারক ব্যবসায়ী। বাংলাদেশি এই ব্যক্তির প্রতারণার শিকার হয়েছে সৌদি আরব, ভারত এবং পাকিস্তানি নাগরিকরাও। তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ হারিয়েছেন।
একপর্যায়ে সৌদি নাগরিকের করা প্রতারণার অভিযোগের কারণে দেশে পালিয়ে আসেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ আল হেলাল নামে ওই ব্যক্তি। তবে এরপরও তার অপতৎপরতা থামেনি। অর্থ আয়ের নতুন ফন্দিতে চট্টগ্রামে খুলে বসেন ‘চট্টগ্রাম প্রবাসী ক্লাব লিমিটিড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকেও আল হেলালের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, জীবিকার তাগিদে দুই যুগ আগে সৌদি আরব পাড়ি জমান আল হেলাল। শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গেলেও নানা প্রতারণার মাধ্যমে বনে গেছেন কোটিপতি। নিত্যনতুন প্রতারণার ফাঁদে ফেলে দেশি-বিদেশিদের কাছ থেকে অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সৌদি ইমিগ্রেশনের তথ্য বলছে, আল হেলাল ২০০১ সালে প্রথমবার দেশটিতে যান। তবে সেখানকার হাইল শহরের ইনভেস্টর (বিনিয়োগকারী) ভিসা নেন ২০০৯ সালে। কিন্তু বিনিয়োগের শর্ত পূরণ করতে না পেরে আবারও সাধারণ ভিসা নেন। পাসপোর্টের তথ্য বলছে, আল হেলাল সৌদিতে অবস্থান করছেন। কিন্তু সৌদিতে সিআইপি হেলালের নামে প্রতারণার মামলা হওয়ার পর পাসপোর্ট জব্দ করে সৌদি সরকার। পরে তিনি পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশে পালিয়ে আসেন। ২০২০ সাল থেকে বর্তমানে দেশেই অবস্থান করছেন।
প্রতারণার শিকার সৌদি প্রবাসীরা গণমাধ্যমকে জানান, আল হেলাল ২০০৪ সালে মক্কা ও জেদ্দা শহরে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ক্রমান্বয়ে ওই দলটির মক্কা ও জেদ্দা শাখার সভাপতিও হন। এরপর ওই বছরই সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী সিআইপি উপাধি পান। মূলত এই দুটি পরিচয় তাকে প্রবাসীদের কাছে পরিচিত করে তোলে।
পরে সিআইপি খেতাব কাজে লাগিয়ে সৌদির হাইল শহরে বিনিয়োগের নামে সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত কয়েক হাজার প্রবাসীর কাছ থেকে তোলেন বিপুল পরিমাণ টাকা। তবে সেই অর্থ বিনিয়োগ না করে আত্মসাৎ করেন। দীর্ঘ চেষ্টায়ও অর্থ ফেরত না পেয়ে প্রতারণার বিষয়ে দূতাবাসে অভিযোগ দেন প্রবাসীরা। তবে উল্টো সেসব প্রবাসীর নামেই চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করেন হেলাল। যারাই তার কাছে টাকা পাবেন, তারাই আদালতে ঘুরছেন মামলা থেকে মুক্তি পেতে।
হেলালের প্রতারণার শিকার আফসার নামে এক প্রবাসী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০১৯ সালের দিকে মক্কার আবরাজ আল বাইত ক্লক টাওয়ারের নিচে একটি শপিংমল বানানোর জন্য আমার কাছে সহায়তা চান হেলাল। আর্থিক সহায়তা করলে তিনি আমাকে ব্যবসায়িক পার্টনার বানাবেন বলে জানান। লোকেশন পছন্দ হওয়ায় রাজি হই। এরপর ধাপে ধাপে তিনি আমার কাছ থেকে ১৮ লাখ রিয়াল বা বাংলাদেশি টাকার প্রায় ৫ কোটি টাকা নেন। এ সময় তিনি ওখানে একটা কফিশপ এবং ছোট ছোট ৩৬টি দোকান ভাড়া নেন। এসব দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসী এমনকি সৌদিদের থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা নেন। এরপর একটি পারিবারিক কাজে আমি দেশে আসি। মাসখানেক পরে ফিরে গিয়ে আর তাকে পাইনি। শুনি তিনি ব্যবসা গুটিয়ে দেশে চলে গেছেন। পরে জানতে পারি, একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনি মাসিক ভাড়া হিসেবে ওসব দোকান নিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ৩ অক্টোবর সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলাটে অভিযোগ করি। এরপর হেলাল এই বছরের ৩০ আগস্ট চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে আমার (আফসারের) নামে ফৌজদারি অভিযোগ এনে মামলা করেন।’
আফসার আরও বলেন, ‘বিদেশিদের নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ নামে একটি সমিতি ছিল। আমিও সে সমিতির সদস্য ছিলাম। সেই সমিতির জন্য তিনি সবার কাছ থেকে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন। সেখানে আমারও স্বাক্ষর করা কয়েকটি স্ট্যাম্প ছিল। হেলাল সেই ২০১৩ সালের স্ট্যাম্পকে ২০১৭ সালের ব্যবসায়িক চুক্তিপত্র বানিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেন।’
মামলাটি বর্তমানে পিবিআই তদন্ত করছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক মুজাম্মেল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। অভিযোগকারী এবং সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তদন্ত শেষ হলে আদালতে অভিযোগপত্র দেব।’ সর্বস্ব হারানো সৌদি নাগরিক আব্দুল হাদি। এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, ‘ব্যবসায় পার্টনার করার কথা বলে হেলাল আমার কাছ থেকে ২৫ লাখ ৭ হাজার ৭৭১ রিয়াল নিয়েছেন। কিন্তু ব্যবসা শুরু না করে সেই অর্থ নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। শুনেছি তিনি দেশে পালিয়ে গেছেন।’
হাদি বলেন, ‘সৌদিতে বাংলাদেশি প্রবাসীদের একটা সুনাম আছে। এখানে লাখ লাখ শ্রমিকের বাইরে অনেক বিনিয়োগকারী আছেন। কিন্তু হেলালদের মতো লোকেরা সৌদি নাগরিকের অর্থ আত্মসাৎ করার কারণে সে দেশের প্রবাসীরা সংকটে পড়বে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হেলাল সৌদি সরকারের আইন অমান্য করেছেন। আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে হেলালের সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’
ভারতীয় নাগরিক ওয়ান সাইদ মুজাহির বলেন, ‘দোকান ভাড়া নেওয়ার জন্য হেলালকে ৬৫ হাজার রিয়াল দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি দোকান দেননি। আবার রিয়ালও ফেরত দিচ্ছেন না। আমার পরিবারের অবস্থা ভালো না। আমি খুবই কষ্টে আছি। হেলালকে বড় ভাই মনে করে অর্থ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এভাবে প্রতারণা করবেন, ভাবতেও পারিনি।’
পাকিস্তানের নাগরিক সিদ্দিক সাওদাগর হেলালের উদ্দেশে দেওয়া ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘হেলাল, আমার বয়স হয়েছে, আমি খুবই অসুস্থ। এখন আমার লাঠিতে ভর দিয়ে চলাচল করতে হয়। আমি ১৬ বছর বয়স থেকে সৌদিতে থাকি। অনেক কষ্টে অর্থ উপার্জন করেছি। তোমার দেশে (বাংলাদেশে) গিয়ে মামলা করার মতো অবস্থাও আমার নেই। এই অবস্থায় অর্থ ফেরত আনা সম্ভব না। আমি তোমাকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখি, তুমি আমার অর্থ কীভাবে ফেরত দেবে, আমাকে জানাও।’
জানা গেছে, ২০২০ সালে চট্টগ্রাম যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে চট্টগ্রাম প্রবাসী ক্লাব লিমিটেডের নিবন্ধন নেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানটির মেমোরেন্ডামে মালিকানায় ১২ জনের নাম দেখা যায়। তারা সবাই প্রতারক হেলালের আত্মীয়স্বজন। প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কোম্পানি বানিয়েছেন তিনি।
এই ক্লাবের বর্তমান সদস্য প্রায় ১৩ হাজার, যারা সবাই প্রবাসী। ক্লাবে চার শ্রেণির সদস্য নেওয়া হয়। এর মধ্যে থ্রি ডায়মন্ড, টু ডায়মন্ড, ডায়মন্ড ও সাধারণ সদস্যরা মাসিক এবং এককালীন চাঁদা দেন। এই চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ পর্যন্ত আছে। ক্লাবের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ চাঁদা আদায় করে সম্পদের কথা বলা হলেও আসলে সদস্যদের কিছুই নেই।
ক্লাবের আয় ও ব্যয়ের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রবাসী ক্লাবের আয় ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকার হিসাব পেলেও ব্যাংক হিসাবে আছে মাত্র ২ লাখ ৯৫ হাজার। এই আয় দেখানো হয় নিবন্ধিত মাত্র ৫ হাজার সদস্যের, আরও ৮ হাজার সদস্যের আর্থিক লেনদেনের কোনো হিসাবই পাওয়া যায়নি।
প্রবাসী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জেদ্দা প্রবাসী মো. মহিউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আল হেলাল চট্টগ্রামে প্রবাসী ক্লাব নামে একটি ক্লাব গঠন করেন। আমাকে সাধারণ সম্পাদক পদ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কোনো কাজে আমাকে যুক্ত করতেন না। যে কারণে মাত্র ২ মাস পরই আমি সেই ক্লাব থেকে পদত্যাগ করি। এরপর কী হয়েছে না হয়েছে, আমি জানি না।
এসব বিষয়ে জানতে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় মোহাম্মদ আল হেলালের সঙ্গে। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একতরফা অভিযোগ করা হচ্ছে। সৌদি আরবে আমি শপিংমল করেছি আব্দুল হাদির নামে। ওই হাদি আফসারের কফিল (মালিক)। আমি কীভাবে টাকা মারব? আফসার উল্টো আমার শপিংমল দখল করেছেন। আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে সৌদি আরব থেকে বের করে দিয়েছে। তারা আমাকে ধরে প্লেনে উঠিয়ে দিয়েছে।’
হেলালের দাবি, ২০১৮ সালে সৌদিতে জমি ভাড়া নিয়ে শপিংমল তৈরি করেন তিনি। কিন্তু ২০১৯ সালে ওই মল দখল করতে তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। এখনো ওই শপিংমল আফসার এবং হাদির নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করেন তিনি। পাকিস্তানিসহ ভিনদেশিদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি কীভাবে টাকা আত্মসাৎ করব? শপিংমলের কাজ শেষ হওয়ার পরই আমাকে তারা বের করে দিয়েছে। আমি তো ভাড়া দিতেই পারিনি।’
কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি দাবি করে হেলাল বলেন, ‘আমার সমিতিতে প্রায় ১৫ হাজার লোক। এখানে ৩-৪ জন লোক আমার পেছনে লাগছে। তারাই আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র করছে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post