প্রতারকদের ছদ্মবেশে অনুদানের জন্য অনুরোধ পাঠানোর ঘটনায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অনুদান দেওয়ার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তির পরিচয় ভালোভাবে যাচাই করা উচিত। এছাড়া, অনুদানের জন্য অনুরোধ পাঠানো অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল ও পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। সোমবার (২৭ নভেম্বর) সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইটস টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে।
ব্রিটিশ সাইবার-নিরাপত্তা সংস্থা নেটক্রাফ্ট বলছে, প্রতারকদের সঙ্গে যুক্ত অ্যাকাউন্টে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ১৬ লাখ ডলার ট্রান্সফার শনাক্ত করেছে তারা। এসব প্রতারকরা জাল ই-মেইল, ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ফোন কলের মাধ্যমে অনুদানের জন্য আবেদন করেছিল। তারা তালিকাভুক্ত বিটকয়েন ঠিকানায় দাতাদের অনুদান পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছিল।
সংস্থাটি বলছে, সেসব ঠিকানায় একটি ক্রিপ্টো-ড্রেনিং সফ্টওয়্যার যুক্ত করা ছিল, যেটি ওই অ্যাকাউন্টগুলোতে অনুদান পৌঁছানো মাত্রই তা প্রতারকদের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতো। এ সফটওয়্যারটি দাতাদের ক্রিপ্টো-ওয়ালেট তথ্য মুছে ফেলে।
২৫ অক্টোবর একটি ব্লগে নেটক্রাফ্ট জানিয়েছিল, ‘২০২৩ সালের মার্চে একটি ব্লগে ক্রিপ্টো-ড্রেনিং আক্রমণের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তারা। সেখানে অপরাধীরা কীভাবে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনকে পুঁজি করছিল তার বর্ণনা করা হয়৷ এই প্রতারক চক্রগুলো একইভাবে গাজা সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি ‘অনুদান’ চাওয়ার প্রচারে নামে।
২০২৩ সালের মার্চে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের আগে, জালিয়াত চক্ররা ‘সব এসভিবি গ্রাহকদের’ সাহায্য করার নামে কিছু ওয়েবসাইট পরিচালনা করেছিল। এসব প্রতারণামূলক ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ডোমেইন ব্যবহার করে প্রতারকরা। এসব ব্যবহার করে সহযোগিতার পরিবর্তে ওইসব গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল তারা।
এই চক্রের সঙ্গে জড়িত অনুদান চক্রকে চিহ্নিত করেছে মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি)। সাইবার-সিকিউরিটি কোম্পানি গ্রুপ-আইবি ‘দ্য স্ট্রেইটস টাইমস’কে জানিয়েছে, যখন বড় কোনও দ্বন্দ্ব বা অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন প্রতারক চক্রগুলো নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে দেয়। সেসময় তারা মানুষের মধ্যে চলমান পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরার মাধ্যমে মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে।
গ্রুপটির ডিজিটাল রিস্ক প্রটেকশন বিভাগের অপারেশন ডিরেক্টর ভ্লাদিমির কালুগিন বলেন, অনুদানের জন্য চলমান দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাচ্ছে এমন সন্দেহজনক ওয়েবসাইটগুলো সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, কিছু ওয়েবসাইট ‘খাদ্য, ওষুধ, ইত্যাদি কেনার জন্য অনুদান সংগ্রহ করে’ এবং সেগুলো ক্রিপ্টো পেমেন্ট গ্রহণ, সরাসরি পিয়ার-টু-পিয়ার মানি ট্রান্সফার অথবা বিভিন্ন দাতব্য মাধ্যমের সাহায্যে ট্রান্সফার করে থাকে।
তিনি সতর্ক করে বলেন,
‘অন্য এক শ্রেণির ভুয়া ওয়েবসাইট আছে যেগুলো স্মারক কেনার প্রস্তাব দেয় এবং ওইসব অর্থ মানবিক কাজে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতিও দেয়।’
সিঙ্গাপুরের সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সির অধীনে সিঙ্গাপুর সাইবার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম ২০২২ সালের মার্চে কিছু প্রতারকদের বিষয়ে সতর্ক করেছিল, যারা ইউক্রেন যুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা নিচ্ছিল। এসব প্রতারকরা তহবিল চুরি করার জন্য স্প্যাম ই-মেইলগুলোতে ডেটা-চুরি করা ম্যালওয়্যার সফটওয়্যার ব্যবহার করতো।
স্ট্রেইটস টাইমস জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই মানবিক ত্রাণ সহায়তার আহ্বানে ব্যাপক সাড়া দিচ্ছে সিঙ্গাপুরের বাসিন্দারা। দেশটির দুর্যোগ ত্রাণ সংস্থা মার্সি রিলিফের চেয়ারম্যান সতওয়ান্ত সিং দাতব্য কেলেঙ্কারির শিকার হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, ‘বিপদে মানুষকে সহায়তা করার জন্য মনে তাগিদ অনুভব করা সহজাত প্রবণতা। অনেক প্রতারকরা এই আবেগের সুযোগ নিয়ে অনুদান সংগ্রহ করে থাকে। আপনার অর্থ বা অনুদান কি সঠিক সংস্থাগুলোতে পাঠাচ্ছেন?’
কালুগিন বলেন, দাতারা হোইজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ওয়েবসাইট তৈরির তারিখ দেখে একটি দাতব্য সংস্থার সত্যতা যাচাই করতে পারেন। হোইজ একটি টুল যা ডেটাবেস অনুসন্ধানের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি নিবন্ধিত ব্যবহারকারী বা ইন্টারনেট উৎসের সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করে। তিনি আরও বলেন, প্রতারকরা একটি নির্দিষ্ট প্রবণতাকে লক্ষ্য করে নিজেদের স্বার্থে দ্রুত একাধিক ওয়েবসাইট তৈরি করে। তাই সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে এমন ওয়েবসাইটগুলোকে বিশ্বাস করার আগে সতর্ক হওয়া জরুরি।’
সাধারণত, অনুদান জালিয়াতি প্রকল্পগুলো সমাজের একটি বড় অংশকে টার্গেট করে পরিচালিত হয়। তারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে না।
গাজা অনুদান কেলেঙ্কারি বিষয়ে ইন্টারপোলকে প্রশ্ন করা হলে এ সম্পর্কে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেনি কর্তৃপক্ষ। তবে তারা স্টেইটস টাইমসকে জানিয়েছে, ‘অনলাইন প্রতারক চক্রগুলো স্বভাবতই সুযোগ সন্ধানী। অর্থলাভের জন্য তারা যেকোনও সংকটকে কাজে লাগাতে চাইবে—যেমনটি আমরা করোনা মহামারির সময়ও দেখেছি।’ সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্সের সাপ্তাহিক স্ক্যামস বুলেটিন অনুসারে, তাদের কাছে গাজা সংঘাত সংশ্লিষ্ট অনুদান জালিয়াতির কোনও রিপোর্ট নেই।
সিং বলেন, দাতাদের সরাসরি দাতব্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। সংস্থাগুলো কতদিন ধরে কাজ করছে এবং তাদের বোর্ড সদস্যদের পরিচয় কী সম্পর্কে তাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, টেলিফোনে ব্যাংকের বিবরণ প্রকাশ না করা বা যাচাই ছাড়া কোনও প্রকার কিউআর কোড স্ক্যান না করাও একটি ভালো অভ্যাস হাতে পারে। গ্রুপ-আইবি-এর কালুগিন বলেন, একটি ভালো ও সুখ্যাতি সম্পন্ন বড় বড় দাতব্য সংস্থার কাছ থেকে অপরিচিত বা নতুন সংস্থাগুলো সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি মনে রাখবেন, প্রতারকদের কাছে সবচেয়ে স্বনামধন্য সংস্থাকে নকল করার জন্য যথেষ্ট প্রযুক্তিগত উপায় রয়েছে। তাই আপনাদের ম্যাসেঞ্জার, সোশ্যাল মিডিয়া, এসএমএস, এমনকি কলের মাধ্যমেও যে কোনও দাতব্য যোগাযোগ মাধ্যমের সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
মার্সি রিলিফ অনুদানের জন্য কোনও সংস্থার নাম ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা এটি নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেয় যে অনুদানের জন্য কোনও সংস্থার নাম ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে না। মার্সি রিলিফ অনুদান চাওয়া ব্যক্তিদেরও পর্যবেক্ষণ করে। তারা নিশ্চিত করতে চায় যে এই ব্যক্তিরা অনুদানের উদ্দেশ্যে সৎ।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post