কোম্পানিগুলো তাদের প্ল্যাটফর্মে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর কনটেন্টের প্রচারণা চালিয়েছে। এছাড়াও, তারা শিশুদেরকে এই কনটেন্টে ঝুঁকির বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি।
“আমি ১২ বছর বয়স থেকেই এ আসক্তির জালে আটকে গিয়েছিলাম। এর ফলে, আমার পক্ষে কৈশোর জীবন শোধরানোও সম্ভব নয়।” –সিলিকন ভ্যালির কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম ঠেকানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন মামলার এক বাদি টেইলর লিটল।
বিবিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, টেইলরের আসক্তি ছিল সামাজিক মাধ্যম, যার ফলে পরবর্তীতে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করার পাশাপাশি বেশ কয়েক বছর হতাশাগ্রস্থ ছিলেন। নিজেকে ননবাইনারি হিসেবে পরিচয় দেওয়া ২১ বছর বয়সী টেইলার বিভিন্ন শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাদেরকে ‘বিগ, ব্যাড মনস্টার’ বলেও আখ্যা দেন। টেইলরের মতে, কোম্পানিগুলো জেনে বুঝে শিশুদের হাতে উচ্চ আসক্তিমূলক ও বিপজ্জনক পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে।
এ কারণেই টেইলর’সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত শত পরিবার বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিবিসি।
গোড়া থেকেই ক্ষতিকারক
ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মালিক কোম্পানি মেটা, টিকটক, গুগল ও স্ন্যাপের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য এ মামলা হতে যাচ্ছে সিলিকন ভ্যালির কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নেওয়া অন্যতম বড় পদক্ষেপ। মামলার বাদীপক্ষের মধ্যে রয়েছে সাধারণ পরিবার থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্কুল ডিস্ট্রিক্টও। তাদের দাবি, সামাজিক মাধ্যমগুলো গোড়া থেকেই ক্ষতিকারক।
সামাজিক মাধ্যম কীভাবে কিশোরদের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে, তার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ১৪ বছর বয়সী ব্রিটিশ স্কুল ছাত্রী মলি রাসেলের ঘটনাকে, এমনই দাবি বাদি পরিবারগুলোর আইনজীবিদের। গত বছর ওয়াশিংটন থেকে এক ভিডিও লিংকের মাধ্যমে তারা মলি’র মৃত্যুর তদন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর লক্ষ্য ছিল, এ তদন্তে মামলার পক্ষে কোনো উপযুক্ত প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় কি না।
ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে মলির নাম। গত সপ্তাহে মামলার পক্ষের পরিবারগুলো বড় এক অনুপ্রেরণা পান, যখন একজন ফেডারেল বিচারক নির্দেশ দেন যে, কোম্পানিগুলো মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীকে (বাক স্বাধীনতার সুরক্ষা) অজুহাত দেখিয়ে মামলার কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে না।
বিচারক গঞ্জালেজ রজার্স আরও নির্দেশ দেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমিউনিকেশন্স ডিসেন্সি অ্যাক্ট’-এর ২৩০ ধারাকেও কোম্পানিগুলো সুরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না, যেখান উল্লেখ রয়েছে, সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো প্রকাশক কোম্পানি নয়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, বাদি পরিবারগুলো যুক্তি দেখিয়েছে যে ‘কঠোর’ বয়স যাচাইকরণ ব্যবস্থার অভাব ও দুর্বল ‘পেরেন্টাল কন্ট্রোল’ ব্যবস্থা কোনমতেই বাক স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
বিচারকের নির্দেশনাকে ‘বড় জয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন পরিবারগুলোর পক্ষের আইনজীবিরা। কোম্পানিগুলো বলছে, এইসব দাবির সত্যতা নেই। আর তারা কঠোরভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করবে।
‘উইথড্রয়ালের মতো’
কলোরাডো’র বাসিন্দা টেইলর বিবিসিকে বলেন, নিজের প্রথম স্মার্টফোন কেনার আগে তিনি খেলাভক্ত ও বাইরের দুনিয়ায় আগ্রহী ছিলেন। থিয়েটার ও নাচের বিভিন্ন আয়োজনেও অংশ নিতেন তিনি।
“ফোন কেড়ে নিলে আমি ‘উইথড্রয়ালের মতো’ (নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের পরবর্তী পর্যায়ের মানসিক অশান্তি) অনুভূতি পেতাম। আর আমি যখন একে আসক্তিমূলক বলছি, তখন আমি একে অভ্যাসগত বিষয় হিসেবে বোঝাতে চাচ্ছি না। বরং, আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমার শরীর ও মস্তিষ্ক উভয় ক্ষেত্রেই এর প্রয়োজনীয়তা আছে।”
এ ছাড়া, সামাজিক মাধ্যমে নিজের প্রথম নোটিফিকেশন ক্লিক করার ঘটনাও মনে রেখেছেন টেইলর।
“এটি কারও ‘পার্সোনাল সেলফ-হার্ম’ পেইজ ছিল, যেখানে ক্ষত ও কাটাকাটির অত্যন্ত স্পষ্ট ছবি দেখা গেছে।”
“১১ বছর বয়সী হিসেবে আমি ওই পেইজে ক্লিক করি। আর কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই ছবিগুলো আমাকে দেখানো হয়। আমি এটি খুঁজে দেখিনি। বা খুঁজতে চাইওনি। এর পরও সেটা দেখেছি। আমার বয়স এখন ২১ বছর। আর এখনও এটা দেখতে পাচ্ছি আমি।”
এর পাশাপাশি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি ও খাদ্যাভ্যাস বিষয়ক কনটেন্ট নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন টেইলর।
“এটা অনেকটা কাল্টের (বিশেষ কোনো সম্প্রদায়) মতো ছিল। আমার অন্তত তেমনই মনে হয়েছে। আপনাকে ক্রমাগত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের এমন ছবি দেখানো হচ্ছে, যা কারও মৃত্যু ছাড়া দেখা সম্ভব নয়।”
“আপনি এর থেকে বেরিয়েও আসতে পারবেন না।”
বিবিসি বলছে, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পৃথক পৃথক পোস্ট, কমেন্ট ও ছবির বদলে তাদের সামগ্রিক নকশার ওপর মনযোগ দেওয়ার মাধ্যমে এ মামলায় অভিনব এক পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন টেইলর ও অন্যান্য বাদির আইনজীবিরা।
তাদের দাবি, অ্যাপগুলোতে থাকা বিভিন্ন ফিচারের নকশা আসক্তি ও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
‘একেবারেই সত্য নয়’
প্রকাশিত বিবৃতিতে মেটা বলেছে, “এ বিষয়ে অভিযোগ তোলা পরিবারগুলোর জন্য আমাদের সমবেদনা রয়েছে।”
“অনলাইনে শিশুদের নিরাপদ ও সহায়ক অভিজ্ঞতা দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী অভিভাবকদের নিশ্চিত করতে চাই, আমরা তাদের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছি।”
এ প্রসঙ্গে বিবিসি’কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি টিকটক। গুগল বলেছে, “এইসব অভিযোগ একেবারেই সত্য নয়। আমাদের প্ল্যাটফর্মে শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়া সবসময়ই আমাদের অগ্রাধিকার ছিল।”
অন্যদিকে স্ন্যাপচ্যাট বলেছে, তাদের প্ল্যাটফর্ম এমনভাবে নকশা করা যাতে মানসিক চাপ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। আর কোনো কনটেন্ট দর্শকদের বিশাল অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে তারা সেটি নিয়ে পর্যালোচনা করে থাকে।
মলি রাসেল
বিবিসি বলছে, মলি রাসেলের পুরো ঘটনাই টেইলরের জানা। ইনস্টাগ্রামে বেশ কিছু নেতিবাচক ও হতাশাজনক কনটেন্ট দেখে আত্মহত্যা করেছিলেন লন্ডনের এই বাসিন্দা।
তার মৃত্যুর তদন্তে উঠে আসে, বিষন্ন অবস্থায় থাকার সময় বিভিন্ন অনলাইন কনটেন্টের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। টেইলরের দাবি, তার ঘটনাও একই ধরনের। “আমি ভাগ্যবান যে বেচে গেছি। তবে, মলির মতো মানুষদের জন্য আমার হৃদয় ভেঙে যায়।”
মলি রাসেল |পারিবারিক ছবি“আমি সুখি। নিজে জীবনকে ভালবাসি। আমি এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছি, যা আগে অসম্ভব মনে হতো।”
এই আইনি পদক্ষেপকে আরও এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যস্থির করেছেন টেইলর। “তারা জানে আমি মরছি। তাদের এ নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। তারা আমার মৃত্যু থেকে অর্থ উপার্জন করতে চায়।”
“সামাজিক মাধ্যমের কার্যক্রম কীভাবে আগের চেয়ে ভাল হবে, তা নির্ভর করে আমাদের মামলা জেতার ওপর ও তাদেরকে এই পরিবর্তন আনতে বাধ্য করার মাধ্যমে। কারণ, প্রচলিত ব্যবস্থায় তারা কখনওই এমনটি করবে না।”
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post