এক টুকরো কাগজে লেখা ৬৭টি শব্দ বিশ্বকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল। এই বিভক্তি এতটাই গভীর যে, আধুনিক সময়ে এসেও তা সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে চলমান সঙ্ঘাতের মধ্যেই এই বেলফোর ঘোষণার ১০৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। ৬৭ শব্দের এই নথি, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসকে চিরতরে বদলে দেয়। ২ নভেম্বর ১৯১৭ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ সরকার প্রথমবারের মতো ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতি তাদের সমর্থন জানায়।
এটি সেই সময়কার কথা যখন ফিলিস্তিন অঞ্চলটি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্থাৎ ওই ভূখণ্ডের প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্রিটিশ সরকারের হাতে ছিল। ইসরাইলিরা এই বেলফোর ঘোষণাকে আজকের আধুনিক ইসরাইল গঠনের ভিত্তি বলে মনে করে। অন্যদিকে আরব বিশ্বের একাংশ মনে করে- এই নথির মাধ্যমে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।
কেননা, এই ফিলিস্তিন অঞ্চল একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ সরকার যখন অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে, তখন আরবরা ব্রিটিশদের সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল। তাই বেলফোর ঘোষণাকে তারা পিঠে ছুরিকাঘাতের মতো মনে করে। বেলফোর ঘোষণার পর ইহুদি অভিবাসীরা ফিলিস্তিন অঞ্চলে ভিড় করতে থাকে।
বেলফোর ঘোষণায় কী আছে?
তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এই ঘোষণাপত্রটি একটি সিল করা খামে ব্যারন লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ব্যারন লিওনেল তখন ব্রিটেনে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন বড় নেতা ছিলেন।
ওই চিঠিতে লেখা ছিল-
প্রিয় লর্ড রথসচাইল্ড মহামান্য সরকারের পক্ষ থেকে, নিম্নলিখিত এই বিবৃতিটি আপনাকে পাঠাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। জায়নবাদী ইহুদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সমর্থন দেয়া এই বিবৃতিটি মন্ত্রিসভায় পেশ করা হয়েছে এবং মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিত হয়েছে।
মহামান্য ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে, তবে এটাও নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, এমন কিছু করা উচিত হবে না, যা ফিলিস্তিনে অবস্থানরত অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার কিংবা অন্য দেশে বসবাসকারী ইহুদিরা যে অধিকার এবং রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে, তার কোনো হানি হয়।
আপনি যদি জায়নবাদী ফেডারেশনের কাছে এই ঘোষণা পৌঁছে দেন, তাহলে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
-আর্থার জেমস বেলফোর
আর্থার জেমস বেলফোর কে ছিলেন?
বেলফোর ঘোষণার নামকরণ করা হয়েছিল আর্থার জেমস বেলফোরের নামে। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার নেতৃস্থানীয় সদস্য, ধনাঢ্য এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে আসা আর্থার জেমস বেলফোর, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করার সাথে সাথে কনজারভেটিভ পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে পার্লামেন্টে যোগ দেন।
স্কটিশ বংশোদ্ভূত, বেলফোর ১৯০২ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি তার কর্মজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেশটির পররাষ্ট্র নীতির সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোয় ব্যয় করেন। বেলফোর এই ধারণাটি প্রচার করেছিলেন যে, ব্রিটিশ সরকারের উচিত জায়নবাদ অর্থাৎ ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়া।
জায়নিজম বা জায়নবাদ হলো- ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে উদ্ভব হওয়া এক রাজনৈতিক আন্দোলন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এই আন্দোলনের উদ্ভব হয়। এই ভূখণ্ডকে ইহুদিরা তাদের প্রাচীন ভূমি বলে মনে করে। বেলফোরকে কৃতিত্ব দেয়া হয় এই কারণে যে- তিনি এই ঘোষণাপত্র জারি করার জন্য যুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভাকে রাজি করিয়েছিলেন।
এজন্য তিনি যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী ইহুদি নেতা, যেমন- চাইম ওয়েইজম্যান এবং লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের সমর্থন পেয়েছিলেন। যদিও অনেকের মতে, তিনি একজন খ্রিস্টান জায়োনিস্ট বা খ্রিস্টান-ইহুদিরাষ্ট্রপন্থী ছিলেন।
মূলত ওল্ড টেস্টামেন্ট বা বাইবেলের প্রথম সংস্করণে ইহুদিদের ইতিহাস পড়ে তার এই বিষয়ে আগ্রহ জন্মায়। তবে অনেকের ধারণা, বেলফোর রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য একটি কৌশলগত কারণে জায়নবাদী প্রকল্পকে সমর্থন করেছেন।
লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ড কে ছিলেন?
ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ বেলফোর এই ঐতিহাসিক চিঠিটি ব্যারন লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি লন্ডনে তার বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো হয়েছিল। ওয়াল্টার রথসচাইল্ড সেই সময় ব্রিটেনের একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং পরিবারের ইংরেজ শাখার প্রধান ছিলেন এবং ব্রিটেনে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট নেতাও ছিলেন।
রথসচাইল্ড আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং পরিবারটি ছিল অত্যন্ত ধনী এবং ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় তারাই অন্যতম বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল। ওই পরিবারেরে এক সদস্য ছিলেন এডমন্ড রথসচাইল্ড, যিনি ছিলেন ইহুদিবাদ বা জায়নিজমের একজন একনিষ্ঠ বিশ্বাসী।
তিনি ফিলিস্তিনে ব্যাপকহারে জমি কিনতে শুরু করেন এবং ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ওই অঞ্চলে ইহুদি বসতি স্থাপনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন। সেই সময়ে রথসচাইল্ড পরিবারের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত ধনসম্পদের মালিকানা ছিল। আরো সহজ করে বললে- এই পরিবারটি ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ইহুদিবাদের জন্য পরিবারটির এই বিপুল পরিমাণ অনুদানকে এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হতো যে এডমন্ড রথসচাইল্ডকে ‘দ্য বেনিফ্যাক্টর’ বা পরোপকারী বলে ডাকা হতো। ১৯১৭ সালে ওয়াল্টার রথসচাইল্ড, তার হাতে বেলফোর ঘোষণাপত্র পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই পরিবারটি ইসরাইলি রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল।
চিঠিটি রথসচাইল্ডকে কেন পাঠানো হয়?
অনেকেরই মনে হতে পারে, এই ঘোষণাপত্রটি স্টুয়ার্ট স্যামুয়েলের পরিবর্তে কেন লিওনেল রথসচাইল্ডকে পাঠানো হয়? স্টুয়ার্ট স্যামুয়েল ছিলেন ব্রিটিশ ইহুদিদের বোর্ড অফ ডেপুটিজের সভাপতি। এই সংগঠনটি ছিল ব্রিটেনে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারী সংস্থা। মূলত ওই সময়ে ব্রিটিশ ইহুদিদের বোর্ড অব ডেপুটিজে মধ্যে ইহুদিপন্থী ইহুদি এবং জায়নবাদ বিরোধী ইহুদিদের মধ্যে বিভাজন ছিল। অর্থাৎ এক দল ইহুদিবাদের সমর্থনে আর অন্য দল এর বিপক্ষে ছিল।
যেখানে কিনা রথসচাইল্ড পরিবারের কোনো আনুষ্ঠানিক পদ ছিল না। তার অবস্থান ছিল নিরপেক্ষ। কিন্তু বাস্তবে তিনি চাইম ওয়েইজম্যানের মতো সেই সময়ে জায়নবাদপন্থী বা ইহুদিপন্থী ইহুদিদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজন ছিলেন। যেহেতু বেলফোরের সাথে রথসচাইল্ডের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তাই তিনি এই চিঠিটি ধনাঢ্য ব্যাংকার রথসচাইল্ডকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
আবার এটাও বলা হয় যে- রথসচাইল্ড নিজেই এই ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরির সাথে জড়িত ছিলেন, যদিও এই দাবির সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বেলফোর ঘোষণার কয়েক বছর পর ১৯২৫ সালে, রথসচাইল্ড ব্রিটিশ ইহুদিদের বোর্ড অফ ডেপুটিজের সভাপতি হন। যা যুক্তরাজ্যের ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান সংস্থা।
চিঠির উদ্দেশ্য কী ছিল?
ব্রিটিশ সরকার আশা করেছিল যে- এই ঘোষণার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইহুদিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) মিত্র শক্তির পাশে থাকতে রাজি হবে। ব্রিটিশ নেতারা এবং কতিপয় ইতিহাসবিদ মনে করতেন, ইহুদি সম্প্রদায়ের যথেষ্ট পরিমাণ অর্থনৈতিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ছিল, যা তাদেরকে যুদ্ধ জয়ী হতে সাহায্য করবে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রথম যুদ্ধের পর ব্রিটেনও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একটি শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে চেয়েছিল।
ওই চিঠিটি লেখার পেছনে উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন এবং পরবর্তীকালে ওই অঞ্চল থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনির বাস্তুচ্যুত হওয়ার পেছনে এই বেলফোর ঘোষণার বড় ধরনের প্রভাব ছিল। ইসরাইলিদের জন্য, বেলফোর ঘোষণাটি এমন একটি নথি ছিল যা ইসরাইলিদের দাবি করা প্রাচীন ভূমিতে ওই জাতির বিকাশ লাভের স্বপ্নকে পূরণ করেছে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য এই বেলফোর ঘোষণা এমন এক দুঃসময় ডেকে আনে যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এমনকি ফিলিস্তিনিরা সমালোচনা করে যে, ওই নথিতে তাদের শুধুমাত্র ‘ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের নাম পর্যন্ত নেয়া হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর, বেলফোর ঘোষণাটি মিত্রশক্তির সমর্থন পায়। সে সময় ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
১৯২২ সালের জুলাইয়ে লিগ অফ নেশনস ওই অঞ্চলে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অনুমোদনও দেয়। লিগ অফ নেশনস ছিল জাতিসঙ্ঘের পূর্ববর্তী একটি সংস্থা। এই অনুমোদনের মাধ্যমে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ওই অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব পায়।
১৯৩০-এর দশকে, এই অঞ্চলে বসবাসকারী আরবরা ক্রমবর্ধমান ইহুদি জনসংখ্যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে। এতে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বিক্ষোভ প্রশমিত করতে গিয়ে, ব্রিটেন ইহুদি অভিবাসনের ওপর কোটা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদি গণহত্যা বা হলোকাস্টের ভয়াবহতা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের চাপ বাড়তে থাকে।
এদিকে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে মধ্যরাতে, ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মেয়াদ শেষ হয় অর্থাৎ ওই অঞ্চলে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটে। ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই অঞ্চলটি ছেড়ে যায়। একই দিনে ইসরাইল তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post