সোনা, এক মূল্যবান ধাতু। এর চাহিদা সব দেশেই রয়েছে। সেই চাহিদা পূরণ করতে চোরাই পথে সোনা পাচারের ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।বাংলাদেশও এই চোরাচালানের আওতামুক্ত নয়। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সোনা চোরাই পথে দেশে আসে। এরপর সেই সোনা ভারতে বা অন্য কোনো দেশে পাচার হয়ে যায়।ভারতে পাচারকালে গত এক বছরে ১৬০ কেজি সোনাসহ ৪২জনকে আটক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক সোনা পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সীমান্তে এক বছরে এই বিপুল সোনা আটক তারই ইঙ্গিত। অনুমান করা যায়, এই সময়ে আটক সোনার বহুগুণ পাচার হয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব সোনা চোরাইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিমান, স্থল ও নৌ পথে বাংলাদেশে এসেছিল পাচারের উদ্দেশ্যেই্।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ সোনা জব্দ করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির সদস্যরা। গত এক মাসে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে ৯ কেজি ৬৪.৩৮৫ গ্রাম সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য আনুমানিক ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৪৭২ হাজার ৬৭৫ রুপি বা ১১ কোটি ৮৮ লাখ বাংলাদেশি টাকা।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে প্রকাশ, চোরাকারবারিরা টার্গেট গন্তব্যে সোনার চালান পৌঁছে দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্লেনে চেপে বাহক অবৈধ উপায়ে সোনার বার নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। এরপর চার থেকে পাঁচবার হাত বদল। এ ভাবেই বাংলাদেশ হয়ে চোরা সোনা চোরাইপথে চলে যায় পাশের দেশ ভারতে। পাচার প্রক্রিয়ায় তারা ব্যবহার করে বেশকিছু কৌশল ও সাংকেতিক কোড।
চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা জানে না একে অন্যের নাম পরিচয়। যখন হাত বদলের সময় হয়, তখন যে ব্যক্তির কাছে চালান পৌছাতে হবে শুধু তার কাছে থাকা নির্দিষ্ট একটি নোটের সিরিয়াল নম্বর হোয়াটস অ্যাপ বা অন্য কোনো মাধ্যমে বাহককে জানানো হয়। কখনও কখনও বলা হয়, যে ব্যক্তি ছেঁড়া টাকার নোট দেখাবে, তার হাতেই যাবে সোনা।
যেসব স্পটে সোনা হাত বদল হয়, এর আশে পাশে নজরদারিতে থাকে আলাদা আরেকটি গ্রুপ। আসল ব্যক্তির কাছে চালান পৌছাচ্ছে কিনা, তা তদারকিতে থাকে তারা। দীর্ঘদিন ধরেই চোরাকারবারিরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে সোনা পাচার করছে। এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে নিরাপদ পথ ভাবছে।
জব্দ সোনার পরিসংখ্যানও দিচ্ছে সে তথ্যের প্রমাণ। দেশের সীমান্ত এলাকায় ২০১৯ সালে এক বছরে পাচারের সময় জব্দ করা হয়েছিল ৫৪ কেজি ২৩৪ গ্রাম সোনা। আর চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই ধরা পড়েছে ১৪২ কেজি ৮১৫ গ্রাম। ধরা পড়া সোনার এ হিসাবই বলে দিচ্ছে, অবৈধ পথে চালান জব্দের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
তবে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ গলিয়ে বছরে সোনা পাচার হচ্ছে এর চেয়েও ২০গুণ। সোনা আমদানির ক্ষেত্রে ভারত অনেকটাই কঠোর।
এ কারণে প্রচুর চাহিদা থাকার পরও দেশটিতে বৈধ পথে সোনার জোগান কম। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) বলছে, ২০২২ সালে ভারতে পাচার করা সোনার সম্ভাব্য পরিমাণ ১৬০ টন (১ টনে এক হাজার কেজি)। অনেকে বলছেন, যে পরিমাণ চোরাই সোনা জব্দ হচ্ছে, এর কয়েকগুণ ফাঁক ফোকর গলিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কঠোর নিয়ম মেনে ভারত সোনা আমদানি করে। তাই অনেক সময় চোরাকারবারিরা অবৈধ পথ বেছে নেয়।
বস্তুত রাজধানীর শাহ জালাল বিমান বন্দরে সোনার চালান আটক হওয়া এখন নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিছু দিন পরপরই এখানে বিপুল পরিমাণ সোনার চালান আটকের ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমান বন্দর থেকেও বেশ কয়েকটি বড় ধরনের সোনার চালান আটক করা হয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিমান বন্দরে সোনা চোরাচালানের ঘটনায় সময়ে সময়ে যাদের আটক করা হয়, তারা কেবল বাহকমাত্র।
মূলত এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে দেশী-বিদেশি পাচারকারী মাফিয়া চক্র। বিমান বন্দরে পাচারসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে জিরো টলারেন্স নিয়ে এগিয়ে আসার কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে মাঝে মধ্যেই বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না।
সোনা চোরাচালান বন্ধে দেশের বিমান বন্দরগুলোতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শুধু সোনা চোরাচালান বন্ধই নয়, মাদক এবং অস্ত্র চোরাচালান বন্ধেও সর্বাধুনিক তল্লাসির বিকল্প নেই। দেশের বিমান বন্দরগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থেই এ ব্যাপারে নজর দিতে হবে।
নিকট অতীতে দেশের একটি জুয়েলার্স থেকে ১৫ মণ সোনা উদ্ধারের ঘটনা দেশবাসীকে চোরাচালানের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করেছে। এই ঘটনায় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চোরাচালান রোধের জন্য তীক্ষ্ম নজর রাখার তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে। চোরাকারবারিদের প্রতি কঠোর হওয়াও জরুরি। দেশ থেকে চোরাচালান একেবারেই বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post