বিমানবন্দর দিয়ে ঘন ঘন বিদেশগামী ‘যাত্রীবেশী চোরাকারবারিদের’ দেশের বাইরে যাওয়ার পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এমন যাত্রীরা বিমানবন্দরে গেলেই তাদের পাসপোর্ট কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। ওই যাত্রীরা যাতে আর কখনও বিদেশে যেতে না পারে তেমন ব্যবস্থার নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।
দেশ থেকে টাকা পাচার ও চোরাচালান প্রতিরোধে অনুসন্ধান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে চাইছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ।
বিদেশ থেকে আসার সময় শুল্ক ফাঁকি, নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্য পরিবহনসহ চোরাচালানের দায়ে যারা অভিযুক্ত এবং যাদের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন রয়েছে তাদের একটি তালিকাও করা হয়েছে। ওই তালিকাসহ একটি চিঠি দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনসহ সকল সংস্থাকে পাঠিয়েছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ।
বিমানবন্দর কাস্টমের যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিন একাত্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে প্রতিদিন অন্তত ২০ কেজি স্বর্ণ বৈধভাবেই দেশে আসছে। এই ২০ কেজি স্বর্ণমূল্যের সমপরিমাণ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছে। দেশ থেকে প্রতিদিন কী পরিমান টাকা পাচার হচ্ছে সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। আবার ওই স্বর্ণগুলো পাচার হয়ে পাশ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে তাতে এটি প্রতিরোধ হবে বলে আমরা আশা করছি।
ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দেয়া কাস্টমের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিমানবন্দরে আগত সম্মানিত যাত্রীদের যাত্রীসেবা প্রদান, রাজস্ব সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের মাধ্যমে অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। এ সকল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কিছু ব্যক্তি বিদেশ হতে আগমনকালে শুল্ক ফাঁকি, নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্য পরিবহনসহ চোরাচালানের দায়ে কাস্টম কর্তৃপক্ষের অভিযুক্ত হয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত মামলাসমূহ বিচারাধীন রয়েছে। এ সকল যাত্রীগণের মাধ্যমে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পরিবহণ ও পাচারের ঝুঁকি রয়েছে।
ওই সকল যাত্রীগণ বিদেশভ্রমনকালে বিমানবন্দর কাস্টমকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো। একই সাথে যাত্রীগণ বছরে কতবার বিদেশ ভ্রমন করেছেন তা জানানোর জন্যও অনুরোধ করা হলো। সরকারি রাজস্ব সুরক্ষা, বৈদিশিক মুদ্রা পাচার ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধকল্পে বিষয়টি অতীব জরুরি। কাস্টম আইনের ১৯৬৯ এর সেকশন ৭ মোতাবেক এ সহায়তা চাওয়া হলো।’
কাস্টম সূত্র জানায়, দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে এক শ্রেণীর যাত্রীরা ঘন ঘন বিদেশ যাচ্ছেন। তারা মূলত মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। স্বর্ণসহ নানা ধরনের পণ্য নিয়ে আসাই এদের কাজ। এসব যাত্রীরা দেশে আসার সময় সঙ্গে থাকা পণ্যের ট্যাক্স-ভ্যাটও পরিশোধ করে। যেসব পণ্য নিয়ে আসে সেগুলোর কেনার টাকা তারা হুন্ডির মাধ্যমে আগেই ওই দেশে পাঠিয়ে। এরকম যাত্রীদেরই ‘যাত্রীবেশী চোরাকারবারি’ বলছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। এদেরকে চিহ্নিত করার জন্যই মূলত এ চিঠি দেয়া হয়েছে।
কাস্টম সূত্র বলছে, দেশে বৈধভাবে যে পরিমান স্বর্ণ আসে সেগুলো বেশিরভাগই পাচার হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দেশ থেকে একদিকে যেমন টাকা চলে যাচ্ছে তেমন স্বর্ণও চলে যাচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়,ওই চোরাকারবারিরা বৈধভাবে যতটা আনা যায় তার চেয়ে বেশি স্বর্ণ নিয়ে আসে। ওই স্বর্ণগুলো জব্দ করে বিভাগীয় মামলাও হয়। পরে তারা কাস্টমের বিচার শাখা থেকে ট্যাক্স-ভ্যাট ও জরিমানা পরিশোধ করে স্বর্ণ নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সরকার শুধু ট্যাক্স-ভ্যাট ও জরিমানার টাকা পায়। আর ওই চোরাকারবারিরা জব্দ করা স্বর্ণ ফেরত পেয়ে সেগুলো পাচার করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টমের এ সিদ্ধান্তের ফলে চোরাচালান ও টাকা পাচার কমে আসবে। কাস্টমের এ উদ্যোগকে যুগান্তকারী বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।
এক কাস্টম কর্মকর্তা বলেন, কাস্টমের সিদ্ধান্তের ফলে, যখন দেখা যাবে এক মাসে একজন পাসপোর্টধারী ব্যক্তি মাসে কয়েকবার আসা যাওয়া করেছেন আর প্রতিবারই তিনি স্বর্ণ এনেছেন সেক্ষেত্রে ওই পাসপোর্টধারী ব্যক্তি চিহ্নিত হয়ে যাবে। তিনি যেনো আর কোনদিন দেশের বাইরে যেতে না পারেন তার জন্য সুপারিশ করবে কাস্টম। যখন দেখা যাবে এভাবে ঘন ঘন বিদেশ যাওয়া ব্যক্তি আর যেতে পারছেন না তখন টাকা পাচারও বন্ধ হবে পাশাপাশি দেশ থেকে স্বর্ণ যেটা পাচার হচ্ছে সেটিও বন্ধ হবে।
এদিকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে তারা দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচারের সময় ৩১ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। আগস্টে উদ্ধার হয় ৩৩ কেজি। জুলাইয়ে আট কেজি, জুনে ১১ কেজি, মে মাসে ২০ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।
বিজিবির এই তথ্যে প্রমাণ হয়, সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচারকারীরা যে স্বর্ণ পাচারের চেষ্টা ও পাচার করছে।
ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা টাকা পাচার ও চোরাচালান রোধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একই সঙ্গে পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি বৃদ্ধি করেছি।
তিনি বলেন, আমরা অনুসন্ধান করেছি, একজন যাত্রী সপ্তাহে দুইবার করে দুবাই যান। আসার সময় ১১০ গ্রাম করে গোল্ডবার ও অলঙ্কার নিয়ে আসেন। এই গোল্ডবার তিনি কাস্টম হলে ঘোষণা দিয়ে ট্যাক্স ও ভ্যাট দেন। জিজ্ঞাসাবাদে ওই যাত্রী জানিয়েছেন, এই গোল্ডবার কেনার টাকা তিনি হুন্ডির মাধ্যমে আগেই পাঠিয়েছিলেন।
যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ বলেন, এর অর্থই হলো টাকাটা পাচার হয়ে গেছে। পাশাপাশি তিনি যে গোল্ডবার নিয়ে এসেছেন সেটিও পাচার হয়ে গেছে। তাহলে দুই দিক থেকেই দেশের ক্ষতি। আবার অনেক সময় কাস্টমের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইরে চলে গেলে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এটি আমলে নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠকের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন থেকে যে সকল যাত্রীকে এভাবে পাওয়া যাবে তারা যেন আর কোনভাবেই দেশের বাইরে যেতে না পারেন এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post