মুস্তাফিজুর শাহিন বুঝতে পারলেন যে তিনি এক ভুল করেছেন। তিনি পালানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার মালিক তাকে ধরে ফেললেন। তাকে আরও বেশি নির্যাতন করা শুরু হল। কি হয়েছিল তার সাথে?
বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর শাহিন যখন চাকরির সুযোগ পেয়ে বিদেশে যান তখন তিনি একবারও ভাবেননি যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে বন্দি জীবন কাটাতে হবে তার। সেখানে তাকে বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এমনকি যখন তখন তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। তবে একটি সাহসী পদক্ষেপের কারণেই রক্ষা পেয়েছেন তিনি।
একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী তার বুটিকের কাপড় তৈরির কাজে শাহিনকে (৫০) কাজের সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তা পরবর্তীতে ভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। সেখানে তাকে বিভিন্ন সময় শারীরিক নির্যাতন করা হয়, এমনকি বার বার হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।
শাহিন বলেন, তার মাঝে মাঝে নিজেকে জীবন্ত লাশ মনে হতো। অবশেষে সেখান থেকে পালিয়ে আসার পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ভানুয়াতুর উপকূলে তার সেই সব ভয়াবহ দিনগুলো বর্ণনা করেন তিনি। জানান, সামান্য খাবারের বিনিময়ে ক্রমাগত ভয় আর শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে কিভাবে তাকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
বন্দিদশা থেকে পালিয়ে আসার পর ভানুয়াতুর পুলিশের কাছে শাহিন বলেন, আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার মনটা ভেঙে গেছে। আমার সব স্বপ্ন, সব প্রত্যাশা ধুলায় মিশে গেছে।
২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শতাধিক বাংলাদেশিকে প্রলোভন দেখিয়ে ভানুয়াতুতে নিয়ে যাওয়া হয় যাদের মধ্যে শাহিন একজন। বাংলাদেশি নাগরিক সেকদাহ সোমন নামের এক পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে এই মানুষগুলোর জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। সেকদাহ সোমন নিজেকে একটি ফ্যাশন বুটিকের ইন্টারন্যাশনাল চেইনের মালিক হিসেবে জাহির করেছিলেন। তিনি এই লোকজনকে জানিয়েছিলেন যে, ওই দ্বীপরাষ্ট্রে তার প্রকল্পে তাদের কাজ দেওয়া হবে।
কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে এর পুরোই উল্টো ঘটনা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপটিতে এই লোকজনকে পাচার করে তাদেরকে ক্রীতদাসের মতো পরিশ্রম করানো হয়েছে। শাহিন এবং তার সাথে থাকা লোকজনের ওপর যে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তা এসব ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর প্রকাশ্যে এসেছে। কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে যে, উন্নত জীবনের আসায় থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে ভানুয়াতুর মতো দেশগুলো এমন একটি গন্তব্য হতে চলেছে যার মাধ্যমে তাদের অন্য কোনো উন্নত দেশে যাওয়ার সহজ পথ হিসেবে দেখানো হচ্ছে বা অল্প পরিশ্রমে বেশি অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে।
দালালরা বলেছিল ভানুয়াতু পৌঁছাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কারণ এর কাছেই অস্ট্রেলিয়া। যে করেই হোক সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেওয়া সম্ভব। শুধু কি তাই? দালালরা লোকজনকে এমন ভরসাও দিয়েছে যে, ভানুয়াতু পৌঁছানো মাত্রই তাদেরকে বিজনেস কার্ড দেওয়া হবে। যে কার্ড পেলে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পরই বাংলাদেশিরা বুঝতে পারেন এসবই ভুয়া।
১৯৮০ সালের ৩০ স্বাধীন হয় ভানুয়াতু। বলা হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে বড় মানব পাচারের ঘটনা। ২০১৮ সালের জুন মাসে ঢাকার উত্তর-পশ্চিমের টাঙ্গাইলের একটি বাস স্টেশনে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সেকদাহ সোমনের সহযোগীদের সঙ্গে দেখা করেন শাহিন। সে সময় তাকে বলা হয় যে, সোমন একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী। সারাবিশ্বে তার বেশ কয়েকটি ব্যবসা রয়েছে।
বাংলাদেশে শাহিনের ছোটখাট একটা ব্যবসা ছিল। সেটা দেখিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে লোন নেন। সেই টাকা তিনি সোমন এবং তার সহযোগিদের হাতে তুলে দেন। এরপরই দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে পরিবার-স্বজনদের বিদায় জানিয়ে ভানুয়াতুতে যাত্রা করেন শাহিন। সেটা ছিল পাঁচ বছর আগের ঘটনা। এখনও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। কারণ তিনি ভানুয়াতুর রাজধানী পোর্ট ভিলায় পৌঁছানোর পরপরই তার কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়।
তাকে সমুদ্র উপকূলের একটি বাংলোতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এবং বেশিরভাগ সময় শুধু বাঁধাকপি আর ভাতই ছিল তার খাবার। সেখানে তিনি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না। শুধুমাত্র কোনো উৎসব আয়োজনে ভালো খাবার পেতেন।
২০২২ সালে সোমন, তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকে মানব পাচার, অর্থ পাচার, হত্যার হুমকি, হামলা, লোকজনকে বন্দি করে কাজে বাধ্য করা এবং দেশের কর্মসংস্থান আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন ভানুয়াতুর পাবলিক প্রসিকিউটর।
সেকদাহ সোমন নিজের অপরাধের কথা শিকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কিভাবে অসহায় লোকজনের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এভাবে পাচারের শিকার হচ্ছেন। বিদেশে ভালো চাকরি এবং বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তাদের এসব দেশে পাচার করা হচ্ছে।
২০২২ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী পাচারের শিকারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে বাংলাদেশিরা। অনেকেই নিজেদের সম্পদ এবং সারাজীবনের সঞ্চয় ব্যয় করে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে বিশেষ করে, তারা উন্নত জীবনের আশায় এসব ধোঁকায় পড়ছে।
ভানুয়াতুর ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান চার্লি উইলি রেক্সোনা বলেন, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য এশীয় দেশ থেকে আসা বিদেশি কর্মীরা প্রায়ই তাকে বলেন যে, তাদের পাসপোর্ট মালিকরা নিয়ে গেছেন। এটা মানব পাচারের একটি সুস্পষ্ট লক্ষণ বলা যায়। তিনি বলেন, এখানে পাচারের ঘটনা ঘটছে, চোরাচালান হচ্ছে কিন্তু সেভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
উইলি রেক্সোনা এই মামলার প্রধান তদন্তকারী। তার মতে, সোমন যেভাবে দেশটিতে অর্থ উপার্জন করেছে এবং এই অপরাধ থেকে দীর্ঘদিন পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে সেটার অন্যতম কারণ হচ্ছে তার দেশে এ ধরনের অপরাধ একেবারেই নতুন বলা যায়। তিনি জানান, সেখানে লোকজনের মধ্যে এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা খুবই কম, তারা পাচারের বিষয়ে সচেতন নন। এমনকি অভিবাসন কর্মকর্তাদের কাছেও এ বিষয়টি নতুন।
২০২২ সালের জুন মাসে, সোমন এবং তার স্ত্রী বক্সু নাবিলা বিবি এবং অন্য দুই সহযোগীকে পাচার, দাসত্ব, অর্থপাচার, হামলা, হত্যার হুমকির জন্য সাজা দেওয়া হয়। সোমন এখনও ভানুয়াতুর কারাগারে রয়েছেন। তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকেও ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে চলতি বছরের শুরুতে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয় এবং জরিমানা দেওয়ার পর বাংলাদেশে নির্বাসিত হন।
এই চার অপরাধীকে পাচার হওয়া ১০৭ বাংলাদেশি ক্ষতিগ্রস্থ নাগরিককে মোট ১০ লাখের বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অর্থ প্রদান করা হয়নি। বিচারের পর থেকে শাহিন ছাড়া বাকিরা সবাই বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। শাহিনের জীবনের অগ্নিপরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। আপাতত ভানুয়াতু বাংলাদেশের চেয়ে তার কাছে নিরাপদ।
তিনি বলেন, আমি আশা করছি যে আমি কানাডা বা অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোথাও স্থায়ী হতে পারব। কারণ আমি এখনও ভানুয়াতুতে বসবাস করতে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। যেহেতু তিনি এই মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী হয়েছিলেন, তাই আশঙ্কা করছেন যে, তিনি বাংলাদেশে ফেরার সাহস করলে সোমন এবং তার সহযোগীরা হয়তো তাকে টার্গেট করতে পারে।
তিনি ভানুয়াতুতে থাকা নিরাপদ মনে করছেন এবং তিনি ইতোমধ্যেই তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে তার সাথে বসবাসের জন্য সেখানে নিতে পেরেছেন। শাহিন আল জাজিরাকে বলেন, আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post