রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে অব্যাহতভাবে। চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) প্রথম ২২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। নিকট অতীতে কোনো মাসে এত কম রেমিট্যান্স প্রবাহ দেখা যায়নি। গত ৬ দিনের (২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর) চিত্র আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নিট রিজার্ভ ৩০ কোটি ডলার কমে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। অথচ ৬ দিন আগেও নিট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ১৪৫ কোটি ডলার। কমেছে গ্রস রিজার্ভও। ২০ সেপ্টেম্বর গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ডলার। ছয় দিনে ২৮ কোটি ডলার রিজার্ভ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭০৫ কোটি ডলারে।
রিজার্ভের এই মহাবিপর্যয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অর্থনীতিবিদরা। কেন রিজার্ভ অব্যাহতভাবে কমছে? এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসার বিষয়টি তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বকেয়া ঋণ পরিশোধ ও আমদানি দেনা মেটানোর কারণে রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ডলার দিতে হচ্ছে। এতেও রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতিও অন্যতম একটি কারণ। এছাড়া রমরমা হুন্ডির বাজার তো চলছেই। তারা বলছেন, দেশে হুন্ডির বাজার এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরাও অনেক প্রভাবশালী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো প্রভাবশালী হুন্ডি কারবারিদের বিরুদ্ধে কিছুই করছে না। তারা ভাসমান বিদেশি মুদ্রা বিক্রেতা ও কিছু মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যে কারণে অনেক প্রবাসী বৈধ পথে ডলার না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহের বিপর্যয় থামানো যাবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আবার ধীরে ধীরে ডলারের বিনিময় হারও বাড়ানো হচ্ছে। ব্যাংকে ডলারের দাম বাড়লে কার্ব মার্কেটেও বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে ডলারের বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে না। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে প্রভাবশালী হুন্ডি কারবারিদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলে তবেই হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
এদিকে রেমিট্যান্স নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে প্রবাসী আয় বাড়াতে বিশেষজ্ঞদের উদ্ভাবনী পরামর্শ চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে পিএফএম সামিট-২০২৩ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক লোক দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তবে সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। তাই প্রবাসী আয় বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কারের পথ খুঁজছে সরকার। এজন্য সংশ্লিষ্টদেরকে উদ্ভাবনী পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান অর্থমন্ত্রী। তার আশা, প্রবাসী আয় বাড়ানো গেলে অর্থনীতির চলমান সব সমস্যা সমাধান সম্ভব। দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার শুরুটা গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে। ওই সময় আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দর বেঁধে দেয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশি দামে ডলার বেচাকেনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশি-বিদেশি ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণও করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব তৎপরতার মুখেই গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক ধাক্কায় প্রায় ৫০ কোটি ডলার কমে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এলেও সেপ্টেম্বরে তা ১৫৩ কোটি ডলারে নেমে আসে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখনই ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কঠোর হয়েছে, তখনই বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় দেখা গেছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৫৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৪১৩ কোটি ৩২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। ওই সময় রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশেরও বেশি। জানা গেছে, ব্যাংক খাতে গতকাল প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) প্রতি ডলার ১১৭-১১৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ব্যাংকের তুলনায় খুচরা বাজারে বেশি দাম পাওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশে হুন্ডির বাজার এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরাও অনেক প্রভাবশালী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ভাসমান বিদেশি মুদ্রা বিক্রেতা ও কিছু মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ ধরনের লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেছেন, ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভুল নীতিতে চলছে। ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নামে ব্যাংকগুলোয় আতঙ্ক তৈরি করেছে। এ কারণে রেমিট্যান্সের বাজার আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া আমদানি দায় মেটানোর পাশাপাশি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। ডলারের সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও প্রতিনিয়ত ক্ষয় হচ্ছে। ২৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হাজার ১২০ কোটি বা ২১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সে হিসাবে গত দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভের পরিমাণ অর্ধেকেরও অনেক নিচে নেমে এসেছে।
দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, সারা বিশ্বেই এখন হুন্ডির বাজার বেশ শক্তিশালী। এ কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। জাতীয়ভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাব ইসলামী ব্যাংকের ওপরও পড়েছে। আমরা রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
তথ্যমতে, কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের সময় তথা ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড ২ হাজার ৪৭৭ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। গত অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। গত দুই অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা চললেও এ সময়ে বিদেশগামী অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, শুধু চলতি ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৬ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৬ জন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশ গেছেন। ২০২২ সালে বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। এর আগে ২০২১ সালেও ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ বাংলাদেশি শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। সব মিলিয়ে গত আড়াই বছরে বিদেশের শ্রমবাজারে নতুন করে ২৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ জন বাংলাদেশি যুক্ত হয়েছেন। এত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশ গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহে সেটির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে চেষ্টা করেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কিছু বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়। যথাসময়ে আমদানি দায় মেটানোর জন্যই বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছিল। এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহও প্রবৃদ্ধিতে ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হতে গিয়ে প্রতি মাসে অন্তত ৫০-৬০ কোটি ডলার ব্যাংক খাতে না এসে হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post