আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানির উচ্চ প্রবৃদ্ধি আর সরকারের বৈদেশিক ঋণেও ডলারের মজুত বাড়ছে না। বরং প্রতিদিনই কমছে এর মজুত। সামনে সরকারি-বেসরকারি বৈদেশিক ঋণের বাড়তি কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা এবং আমদানির বাড়তি চাহিদা নতুন করে ভয় ধরাচ্ছে। বেশি রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) আর বৈদেশিক ঋণ থেকে আসা ডলার রাতারাতি রিজার্ভ বাড়িয়ে দেবে এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বরং তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, ডলার আসার চেয়ে যাওয়ার চাপ বাড়ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সামনে রিজার্ভের কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।
এ বিষয়ে এবিবির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। এ বছরটা এভাবেই পার করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি ঋণ মিলিয়ে এ বছর কয়েক বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। এটা একটা বড় ইস্যু। সামনে নির্বাচন থাকায় বাইরে থেকে যাদের বিনিয়োগ আসার কথা, তাদের মধ্যেও একটা অনিশ্চয়তা কাজ করছে। এ ছাড়া রপ্তানি চাপে আছে। আর আমদানি কমিয়ে আনলেও কতটুকু কমানো যাবে? খুব বেশি কমানো যাবে না। এর সঙ্গে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সম্পৃক্ত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ হিসাবমতে, গত দুই বছরে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন (৪,৮০০ কোটি) ডলার থেকে নেমে এখন ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে অর্থাৎ অর্ধেকের নিচে। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে ডলারের অস্থিরতায় বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন সময় পার করছে। ডলারের দর জোর করে দীর্ঘদিন ৮৫ টাকায় আটকে রাখলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা ১২০ টাকায় উঠেছে। জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দাম আর বাড়তি চাহিদার কারণে ডলার বাগে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরো ব্যবস্থাপনা প্রায় ওলট-পালট হয়ে যায়। বাজারে ডলারের অস্বাভাবিক দামের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য হয়ে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকগুলোর কাছে। গত জুলাই মাসেই ১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার প্রতি দুই মাস পরপর আমদানির দায় হিসেবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার করে আকুর বিল শোধ করতে হয়। এভাবে মজুত কমছে। বাজার অস্থির হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। উল্টো আমদানিতে ক্ষেত্রবিশেষে ১২০ টাকা পর্যন্ত ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো। চোরাই বাজারে ডলারের বেশি দর আর ব্যাংকিং চ্যানেলে কম থাকায় হুন্ডিও থামানো যাচ্ছে না। চিকিৎসা, বিদেশে পড়তে যাওয়ার কারণেও প্রতি মাসে বিপুল অঙ্কের ডলার চলে যাচ্ছে।
রপ্তানি, প্রবাসী আয়েও সুফল কম
রপ্তানি কিছু বাড়লেও ডলারের মজুতে এর প্রভাব কম। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৫৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। অথচ ডলার হিসেবে ফিরে এসেছে ৪৩ বিলিয়ন। প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় ফিরে আসেনি। সুতরাং রপ্তানি বাড়ার সুফল পড়েনি ডলারের মজুতে। প্রবাসী আয়ও আসছে কম হারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পাঠিয়েছেন ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে এসেছিল ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও তা ডলার খরচের তুলনায় কম। তবে গত বছরের জুলাইয়ে ২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও এ বছরের জুলাইয়ে এসেছে ১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। বলা যায়, মাসের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক ঋণের প্রাপ্তি কম, শোধ বেশি
সরকার বৈদেশিক ঋণ নিয়ে ডলারের মজুত বাড়াতে চাইছে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে চাইছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে। গত সপ্তাহেই বিশ্বব্যাংক ও এডিবি প্রায় ৬০ কোটি ডলার (সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা) ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু এই ঋণ আসবে ধাপে ধাপে। আইএমএফ যে ৪৭০ কোটি ডলার দিচ্ছে, সেটাও একসঙ্গে জমা হচ্ছে না। আসবে ধাপে ধাপে। বলা যায়, বৈদেশিক ঋণ আসার হারও ভালো নয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় কমেছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ইআরডির সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় ৯ দশমিক ২৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আগের অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের রেকর্ড ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছিল।
বিশ্ববাজারে সুদের হার বাড়ায় এবং মোডিস ও এসঅ্যান্ডপি দেশের ঋণমান কমানোয় বেসরকারি খাতও বেশি হারে বিদেশি ঋণ পাচ্ছে না।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ১০ বছরে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। আর বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এসব ঋণ শোধ করার চাপ ক্রমেই বাড়ছে। গত অর্থবছরেই বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে শোধ করতে হবে ৩২৯ কোটি ডলার। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ মোট ১২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধ করতে হবে। এর মধ্যে সরকারি খাতের সোয়া ৩ বিলিয়ন ডলার আর বাকিটা বেসরকারি খাতের। গত মাসে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ কমেছে ২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি কমিয়েও কাজ হচ্ছে না
ডলার খরচ কমানোর জন্য আমদানিতে কড়াকড়ি চলছে। চাহিদা থাকার পরও কৃত্রিমভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটা দীর্ঘমেয়াদি দেশের উৎপাদনব্যবস্থা ও রপ্তানিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। আমদানি কমায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি কমে হয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ১৬ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু তাতেও রিজার্ভ কমে ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই এসে ঠেকেছে। সামনে রপ্তানি আর স্থানীয় উৎপাদনের চাহিদা বাড়লে আমদানি কতটুকু ঠেকিয়ে রাখা যাবে, তা নিয়েও শঙ্কা আছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান আজকের পত্রিকাকে বলেন, রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগের জায়গাটা অনেক বেড়েছে। রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমছে। এই পরিস্থিতির রাতারাতি উন্নতি হবে এমন লক্ষণ নেই। এই পরিস্থিতি হয়তো পুরো অর্থবছরেই যাবে। সরকার যে কৌশল নিচ্ছে, সেখানেও কিছু ঘাটতি আছে। ডলারের রেট, রপ্তানির উন্নয়ন, রেমিট্যান্স অফিশিয়াল চ্যানেলে আনার ক্ষেত্রেও কোনো সাফল্য নেই। টাকা পাচারের সঙ্গে হুন্ডিরও একটা সম্পর্ক আছে। এগুলোর উন্নতি হলে অর্থনীতি কিছুটা গতিশীল হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post