১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মাইকেল কলিন্সকে অ্যাপোলো-১১-এর পাহারায় রেখে চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন নিল আর্মস্ট্রং, এর পরই নামেন বাজ অলড্রিন। চাঁদে প্রথম মানুষ হিসেবে ইতিহাস গড়লেন তারা। আর এভাবেই চন্দ্রজয় করে নিল পৃথিবীর মানুষ। চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন যুদ্ধ শুরু হয় ১৯২৬ সালে রকেট আবিষ্কারের পর। এর পরই শুরু হয়ে যায় চাঁদের বুকে একের পর এক অভিযান। চন্দ্রাভিযান মানেই যে চাঁদে মানুষ যাবে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। কোনো কোনো অভিযান চাঁদের কক্ষপথে অরবিটার, প্রোব বা ফ্লাইবাইস পাঠানোর জন্যও পরিচালনা করা হয়। এসব অরবিটার, প্রোবের কাজ হচ্ছে চাঁদকে প্রদক্ষিণ ও পর্যবেক্ষণ করা। তবে অধিকাংশ অভিযানই পরিচালনা করা হয় চাঁদে অবতরণ করানোর জন্য। চাঁদে অবতরণ বলতে বোঝায় কোনো মনুষ্যবাহী বা মনুষ্যবিহীন মহাকাশযানের চাঁদের মাটি স্পর্শ করা। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ চাঁদের উদ্দেশে নভোযান পাঠিয়েছে। ফ্লাইবাইস, ইমপ্যাক্ট প্রোব, অরবিটার, ল্যান্ডার, রোভার এবং ক্রুড মিশনসহ এখন পর্যন্ত মোট ১৪৬টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে চাঁদকে ঘিরে। চাঁদে এই অভিযানগুলো পরিচালনার তালিকায় রয়েছে ১১টি দেশ ও একটি সংস্থাÑ সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা, চীন, ভারত, লুক্সেমবার্গ, ইসরায়েল, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং রাশিয়া।
চন্দ্র জয় করা চার দেশ
সোভিয়েত ইউনিয়ন : চাঁদের বুকে প্রথম মিশন শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় মহাশূন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্র অভিযানে আমেরিকার আগে সাফল্য পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি লুনা-১ চন্দ্র অভিমুখে যাত্রা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় যানটি। তবে ১৩ সেপ্টেম্বর সাফল্যের সঙ্গে চাঁদে অবতরণ করে লুনা-২। তবে এটি হার্ড-ল্যান্ডেড মহাকাশযান ছিল। ৪ অক্টোবর চাঁদের চারদিকে প্রদক্ষিণ করার জন্য মহাকাশে স্থাপিত হয় লুনা-৩। চাঁদের অন্ধকার দিকের ছবি তুলে পাঠায় এই যানটি। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি চাঁদের বুকে লুনা-৯ সফট ল্যান্ডিং করলে প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদে মহাকাশযান অবতরণের গৌরব অর্জন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরের বছরগুলোয় লুনা-১৩, ২০, ২১ যানগুলোও সফট ল্যান্ডিং করতে সক্ষম হয়। এই প্রোগ্রামের সবশেষ মিশন ছিল লুনা-২৪। ‘লুনা প্রোগ্রামের’ আওতায় ১৯৫৯-৭৬ সালের মধ্যে ২৪টি চন্দ্র অভিযান পরিচালনা করেছিল সোভিয়েত, যার ১৫টি সফল হয়েছিল।
আমেরিকা : মহাকাশ জয়ে স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েতের সঙ্গে পারছিল না আমেরিকা। পরে ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কেনেডির উদ্যোগে নাসার অধীনে শুরু হয় প্রায় ২৪.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট, ‘প্রজেক্ট অ্যাপোলো’। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ১৪টি অ্যাপোলো মিশন পরিচালনা করে নাসা। লুনা-৯ ল্যান্ড করার কয়েক মাস পরে সার্ভেয়র-১ নামের একটি স্পেস ক্র্যাফট চাঁদে সফলভাবে অবতরণ করলে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে চাঁদে মহাকাশযান অবতরণ করানোর কৃতিত্ব অর্জন করে আমেরিকা। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো-১১ রকেটের মাধ্যমে সফলভাবে প্রথমবারের মতো মানুষ চাঁদে অবতরণ করাতেও সক্ষম হয় দেশটি।
দেশটি মোট ১১টি সফট ল্যান্ডিং করেছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশিবার চাঁদে অবতরণের রেকর্ড। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা ছয়টি মহাকাশ মিশনের মাধ্যমে চাঁদে ১২ জন মানুষকে অবতরণ করাতে পেরেছিল।
এই প্রোগ্রামের সবশেষ ক্রুড মিশন ছিল অ্যাপোলো-১৭। এই রকেটের তিনজন নভোচারী- রন এভান্স, ইউজিন সারনান এবং হ্যারিসন শ্মিট চাঁদের বুকে পা রাখা সবশেষ মানুষ। আমেরিকা ছাড়া আজ অবধি কোনো দেশ চাঁদের বুকে মানুষ অবতরণ করাতে পারেনি।
চীন : একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চন্দ্রাভিযান নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে চীন ও ভারত। ২০০৭ সালে চ্যাঙই লুনার মিশনের ঘোষণা দেয় চীন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চ্যাঙই-৩ চাঁদের বুকে সফট ল্যান্ডিং করতে সক্ষম হয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে অভিজাত ‘স্পেস ক্লাব’-এ ঢুকে যায় চীন। ২০১৮ সালে চ্যাঙই-৪ এবং ২০২০ সালে চ্যাঙই-৫ মিশন দুটিও সফল হয়।
ভারত : চাঁদে একটি অরবিটার পাঠানোর উদ্দেশ্যে ইসরো ২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ পাঠায়। কিন্তু চন্দ্রপৃষ্ঠের অতিরিক্ত উত্তাপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে না নিতে পারায় যান্ত্রিক গোলযোগে নষ্ট হয়ে যায় যানটি। তবে চাঁদের বুকে পানির অস্তিত্বের প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছিল চন্দ্রযান-১। ২০১৯ সালে আবারও চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর উদ্যোগ নেয় ভারত। কিন্তু এই অভিযানটিও ব্যর্থ হয়। দক্ষিণ মেরুতে সফট ল্যান্ডিংয়ের বদলে হার্ড ল্যান্ডিং করতে গিয়ে অত্যধিক গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে চাঁদের বুকেই আছড়ে পড়ে ধ্বংস হয় চন্দ্রযান-২। কিন্তু এবার আগের দুবারের সব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে চার বছর সময় নিয়ে চন্দ্রযান-৩ প্রস্তুত করে ইসরো। পরে ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট সফলভাবে মহাকাশযানটি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফট ল্যান্ডিং করলে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদের মাটিতে নামার ইতিহাস গড়ে ভারত। চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে তারাই প্রথম দেশ।
চাঁদে পা রেখেছিলেন যারা
১৯৬৯ সালে নাসা চাঁদে প্রথম মানুষ পাঠায়। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ৬টি অ্যাপোলো মিশনে ১২ জন নভোচারী চাঁদের মাটিতে পা রেখেছেন। চাঁদের বুকে শেষবার মানুষ নেমেছিল ১৯৭২ সালে। চাঁদে যে ১২ জন মানুষ পা রেখেছেন তাদের নাম ও যানের বিস্তারিত নিচে দেওয়া হলো :
নীল আলডেন আমস্ট্রং (অ্যাপেলো-১১ মিশন)
এডুইন বাজ অল্ড্রিন (অ্যাপেলো-১১ মিশন)
চার্লস পেটে কোনরাড (অ্যাপেলো-১২ মিশন)
অ্যালেন লাভর্ন বিন (অ্যাপেলো-১২ মিশন)
অ্যালেন বাটলেট শেপার্ড (অ্যাপেলো-১৪ মিশন)
এডগার ডিন মিচেল (অ্যাপেলো-১৪ মিশন)
ডেভিড র্যানডলফ স্কট (অ্যাপেলো-১৫ মিশন)
জেমস বেনসন আরউইন (অ্যাপেলো-১৫ মিশন)
জন ওয়াটস ইয়াং (অ্যাপেলো-১৬ মিশন)
চার্লস মস ডিউক (অ্যাপেলো-১৬ মিশন)
ইউজিন সেরনান (অ্যাপেলো-১৭ মিশন)
হ্যারিসন হাগান স্মিত (অ্যাপেলো-১৭ মিশন)
তাদের মধ্যে এখনো অবধি চারজন বেঁচে আছেন- এডুইন বাজ অল্ড্রিন, ডেভিড র্যানডলফ স্কট, চার্লস মস ডিউক, হ্যারিসন হাগান স্মিত।
এত টাকা খরচ করে চাঁদে কেন যায়?
চাঁদে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ অনুসন্ধান। সেখানে পানির উপস্থিতি, খনিজের উপস্থিতিসহ নানা বিষয়ে অনুসন্ধানই চাঁদে যাওয়ার মূল লক্ষ্য। এর আগে বিজ্ঞানীরা সেখানে পানির অস্তিত্ব নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। চাঁদে যদি পর্যাপ্ত পানির উপস্থিতি পাওয়া যায়, তা হলে সেখানে মানুষের বসতি গড়া, চাঁদে মূল্যবান খনিজসম্পদ আহরণ এবং মঙ্গল গ্রহের বিভিন্ন অভিযানও সম্ভব হবে। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে অ্যাপোলো অভিযানের আগেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করতে পেরেছিলেন যে, চাঁদে পানির উপস্থিতি থাকলেও থাকতে পারে। ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে এবং ’৭০-র দশকের শুরুর দিকে অ্যাপোলো চন্দ্রাভিযানে যাওয়া নভোচারীরা চাঁদের বুক থেকে যেসব উপাদান সংগ্রহ করে এনেছিলেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা চাঁদের বুকে পানির অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাননি। ২০০৮ সালে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই উপাদানগুলোকে আবারও পরীক্ষা করে সেগুলোতে হাইড্রোজেনের উপস্থিতির প্রমাণ পান। ২০০৯ সালে ভারতের প্রথম চন্দ্রাভিযান চন্দ্রযান-১-এ থাকা নাসার একটি যন্ত্র চাঁদের পৃষ্ঠে পানি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
রাশিয়ার অভিযান ব্যর্থ হয়েছে যে কারণে
সাতচল্লিশ বছর পর চন্দ্রযান পাঠিয়েছিল রাশিয়া। এবার লুনা-২৫ নামের মহাকাশযানটি চাঁদে পাঠিয়েছিল দেশটি। কিন্তু বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের কক্ষপথ নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এটি ছিল রাশিয়ার প্রথম মহাকাশ যান যেটি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের কথা ছিল। কিন্তু এই মহাকাশযানটি অবতরণের পূর্ববর্তী কক্ষপথে অগ্রসর হওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয়। রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস জানিয়েছে, গ্রিনিচ মান সময় ১১টা ৫৭ মিনিটে লুনা-২৫ চন্দ্রযানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা জানায়, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে, ৮০০ কেজি ওজনের চন্দ্রযানটি চাঁদের উপরিভাগের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে বিধ্বস্ত হয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post