অব্যাহত ডলার সঙ্কটের কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের ২১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের তহবিল আটকে রেখেছে বাংলাদেশ। এ কারণে বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে বাংলাদেশ থেকে যারা যাচ্ছেন, একই গন্তব্যে ভারত থেকে ভ্রমণকারীদের তুলনায় তাদের উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দিতে হচ্ছে টিকেটের দাম। বিস্ময়কর হলেও এই বাস্তবতাই সামনে এসেছে। উদাহারণ হিসাবে বলা যায় এমিরেটস এয়ারলাইনসের কথা। কলকাতা থেকে দুবাইগামী ফ্লাইটে টিকেটের সর্বনিম্ন দাম তারা নিচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার টাকা কিছু বেশি। কিন্তু, ঢাকা থেকে দুবাইগামী ফ্লাইটে একই এয়ারলাইন নিচ্ছে ৬৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ ও ভারতে ব্যবসা করা অন্য সব আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রেও টিকেটের দামের এই ব্যবধান চোখে পড়ে। এভিয়েশন শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা জানান, অব্যাহত ডলার সঙ্কটের কারণে টিকেট বিক্রির মাধ্যমে করা আয় প্রত্যাবাসন করতে না পারায় বিদেশি এয়ারলাইনগুলো কম দামে টিকেট বিক্রি বন্ধ করেছে। একই আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণকারীদের – ভারত থেকে ভ্রমণকারীদের তুলনায় অনেক উচ্চ দাম দেয়ার এটা অন্যতম কারণ।
বিমানবন্দরের সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে প্রতিদিন ৩০ হাজার আন্তর্জাতিক যাত্রী যাচ্ছেন। এ সমস্যার গভীরতা তুলে ধরে এয়ারলাইনসগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন- ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) তাদের এক সাম্প্রতিক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে যে, এয়ারলাইনসগুলোর ২১৪ মিলিয়ন ডলার তহবিল আটকে রেখেছে বাংলাদেশ; ফলে তহবিল প্রত্যাবাসনের বাজে পারফর্ম্যান্সেও বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানটি এখন বাংলাদেশের। গত বছরের ডিসেম্বরে আটকে থাকা তহবিলের পরিমাণ ছিল ২০৮ মিলিয়ন ডলার; এসময় তহবিল প্রত্যাবাসন র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয় অবস্থানে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এর চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান স্বীকার করেন যে, ডলার সঙ্কটকালে তহবিল আটকে যাওয়ায় বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। এরপরও বিপুল এভিয়েশন বাজারের কারণে তারা এদেশে কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে বলেও জানান তিনি। তবে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তহবিল আটকে থাকাই টিকেটের উচ্চ দামের একমাত্র কারণ নয়। এক্ষেত্রে তাদের পরিচালন ও জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ারও ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া, ভারতে এয়ারলাইন শিল্প সরকারের ভর্তুকি পায়। বাংলাদেশে তা পায় না। এটাও মূল্য ব্যবধানের আরেক কারণ বলে উল্লেখ করেন মফিদুর রহমান। এয়ারলাইনসগুলো বিভিন্ন প্রাইস রেঞ্জ বা স্লাবের (মূল্যসীমা) টিকেট বিক্রি করে। বিদেশি একটি এয়ারলাইনের একজন সেলস এক্সিকিউটিভ বলেন, এমিরেটস বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য সর্বনিম্ন টিকেটের দাম পরিবর্তন করেনি, কিন্তু বাংলাদেশে আর নিচের স্লাবের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। এক কথায়, বাংলাদেশের বাজারে অন্তত চারটি নিম্ন মূল্যসীমার টিকেট বিক্রি বন্ধ রেখেছে এয়ারলাইনসগুলো। তবে দেশের বাইরে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এয়ারলাইনসগুলো টিকেটের দাম না বাড়ালেও, কম দামের টিকেট কেনার উপায় না থাকায়- বাংলাদেশের ভ্রমণকারীদের উচ্চ ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
একজন বিক্রয় প্রতিনিধি ব্যাখ্যা করে বলেন, দেশের ব্যাংকখাতে তীব্র ডলার সঙ্কটের কারণে প্রায় ছয় মাস আগেই বিদেশি এয়ারলাইন অপারেটররা বাংলাদেশে নিম্ন মূল্যের টিকেট বিক্রি বন্ধ করে। তখন থেকেই ডলার সঙ্কটের কারণে এসব কোম্পানির তহবিল প্রত্যাবাসন আটকে যেতে থাকে। ফলে মুদ্রা বিনিময় হারে লোকসান হওয়া ঠেকাতেই তারা বাংলাদেশের বাজারে কম দামের টিকেট বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এতে দরিদ্র অভিবাসী শ্রমিকসহ সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।শুধু যাত্রীদের দুর্দশা সৃষ্টিতেই থেমে নেই তহবিল আটকে যাওয়ার পরিণতি। বরং তাতে বিমান পরিচালক সংস্থাগুলোর আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। বর্তমান ডলার সঙ্কট দেখা দেয়ার আগে, দরকারি কাগজপত্র প্রস্তুতের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে আয় প্রত্যাবাসনে ৩-৪ মাস দেরি হতো বিদেশি এয়ারলাইন অপারেটরদের। ফলে মুদ্রা বিনিময় হারে তাদের কিছুটা ক্ষতিও সহ্য করতে হতো। কিন্তু, ডলারের বিনিময় দর তখন স্থিতিশীল থাকায়, এই লোকসান ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু, গত এক বছরে ডলারের দামে ব্যাপক ওঠানামা প্রচুর লোকসান করেছে তাদের। যেমন আগে ডলারের ৯০ টাকা দামের ভিত্তিতে এয়ারলাইন অপারেটররা টিকেট বিক্রি করেছে। কিন্তু, সেই অর্থ তারা নিজ দেশে (যেদেশে তাদের সদর দপ্তর) পাঠাতে পারেনি। অর্থ পাঠানোর জন্য তারা বাজার থেকে ১১০ টাকার বেশি দর দিয়ে প্রতি ডলার কিনতে বাধ্য হয়। এতে বিনিময় দরেই তাদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। এজন্যই তারা বাংলাদেশে শুধু উচ্চ মূল্যের টিকেট বিক্রি করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, ব্যাংকখাতে ডলার সঙ্কটের ফলেই তহবিল আটকে রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. জাকির হোসেন বলেন, বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর তহবিল আউটওয়ার্ড রেমিট্যান্সে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো বিধিনিষেধ দেয়া হয়নি। ‘এয়ারলাইনের ফান্ড রেমিট করার দায়দায়িত্ব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোর। কিন্তু, ডলার সঙ্কটের কারণে তারা সেটা করতে পারেনি। এসব তহবিল পাঠাতে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক, কারণ ডিলার ব্যাংককে ডলার ব্যবস্থাপনার অনুমোদন দেয়াই আছে।’
সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে, দেশি-বিদেশি সব এয়ারলাইনসকে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে– ডলারের পরিবর্তে টাকায় বিমান ভাড়া নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে যা কার্যকর হবে। টিকেটের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং ডলারের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব থেকে গ্রাহকদের সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া, বিমান পরিচালক সংস্থাগুলোকে সহায়তা দেয়ার জন্য তাদের কাছে সরকারকে ডলারের পরিবর্তে টাকায় জ্বালানি বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে বেবিচক। তবে এই প্রস্তাব এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি।
আইএটিএ’র একটি প্রতিবেদন অনুসারে, যেসব দেশে এয়ারলাইনের তহবিল আটকে রয়েছে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানটি বাংলাদেশের। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের এয়ারলাইন শিল্পের মোট আটকে থাকা তহবিলের পরিমাণ ৪৭ শতাংশ বেড়ে ২.২৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে যা ছিল ১.৫৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বিশ্বের মাত্র ৫টি দেশে এই তহবিলের ৬৮ শতাংশ আটকে রয়েছে। এরমধ্যে নাইজেরিয়ায় রয়েছে ৮১২.২ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশে ২১৪.১ মিলিয়ন ডলার, আলজেরিয়ায় ১৯৬.৩ মিলিয়ন, পাকিস্তানে ১৮৮.২ মিলিয়ন এবং লেবাননে ১৪১.২ মিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিক এভিয়েশন বাণিজ্য সংস্থাটি তহবিল আটকে থাকার পরিমাণ বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ, এসব দেশের আকাশপথে সংযোগ ব্যাহত হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে। সূত্র: টিবিএস।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post