ভাগ্য বদলাবে, পরিবারে সচ্ছলতা ফিরবে- এমন আশায় সিরাজগঞ্জের মর্জিনা বেগম (৩৭) এবং গাজীপুরের ফাতেমা বেগম (২৯) দু’জনই গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি মাসে দু’জনই লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। একজনের মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে স্বাভাবিক, আরেকজনের দুর্ঘটনা। এ বছরের জানুয়ারিতে এভাবে ১১ জন নারী লাশ হয়ে ফিরেছেন। একইভাবে ফরিদপুরের রেশমা বেগম (২৯), কুমিল্লার শারমীন আক্তার (৩১) এবং যশোরের মাহফুজা খাতুন (৩৬) তিনজনই গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু গত বছর তিনজনই দেশে ফিরেছেন লাশ হয়ে। মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে ‘আত্মহত্যা’। আবার জর্ডান থেকে আসা যশোরের সুমী বেগম (৩১), ওমান থেকে আসা সুনামগঞ্জের নাসিমা বেগমের (২৬) মৃত্যুর কারণ লেখা ‘স্বাভাবিক’।
গত বছর এভাবে ১১৭ জন নারীর লাশ এসেছে। কেবল মর্জিনা, ফাতেমা, রেশমা, আনোয়ারা, সুমী, শারমীন কিংবা মাহফুজা নন; ২০১৬ সাল থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৭২৫ জন নারী প্রবাস থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন। বিমানবন্দরের তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, এ সময় যেসব নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে, তাঁদের মধ্যে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যুর সনদ লেখা লাশের সংখ্যা ২৭২। এ ছাড়া ১৩৮ জনের মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল ‘স্ট্রোক’। ১১৬ জনের ক্ষেত্রে ‘আত্মহত্যা’। ১০৯ জনের ক্ষেত্রে ‘দুর্ঘটনা’। ১৬ জনের ক্ষেত্রে ‘হত্যা’। এর বাইরে অন্যদের করোনা, ক্যান্সার, অজানা রোগ বা কোনো কারণ উল্লেখ নেই।
বিমানবন্দরের কার্গো গেট থেকে যখন লাশগুলো পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয় কিশোরী মেয়ে নদীর মরদেহ নিতে এসে অঝোরে কাঁদছিলেন তাঁর স্বজনরা। ১৩ বছরের কিশোরী নদীকে ২৫ বছর বয়স দেখিয়ে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। কাগজপত্রে ‘আত্মহত্যা’ বলা হলেও তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে অথবা হত্যা করা হয় বলে দাবি পরিবারের। নদীর মা বিউটি আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছিলেন, ‘মেয়েটা সৌদি আরবে যাওয়ার পর থেকেই সমস্যায় পড়ে।
এজেন্সিকে বারবার বলা হলেও ওরা ব্যবস্থা নেয়নি। এখন ওরা আমার বাচ্চা মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। কাগজে লেখা আত্মহত্যা, কিন্তু আমি দেখেছি আমার মেয়ের গলায় কোনো দাগ নেই। অথচ সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। আমি কার কাছে বিচার চাইব?’ একই রকম অভিযোগ কুলসুমের মায়ের। তাঁর দাবি, কুলসুম যে বাড়িতে কাজ করত সেই বাড়ির নিয়োগকর্তা ও তার ছেলে মেরে দুই হাত-পা ও কোমর ভেঙে দিয়েছে। একটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। তারপর ওই অবস্থায় রাস্তায় ফেলে গেছে। সৌদি পুলিশ সেখান থেকে কুলসুমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
কুলসুমের মা নাসিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, রমজান মাসের শেষ রোজার দিন দুপুরে ফোন করে তাদের জানানো হয়, কুলসুম হাসপাতালে। তারা তখন জানতে পারেন মালিকের খারাপ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মারধর করে ফেলা রাখা হয়। এরপর কোরবানি ঈদের পরদিন মেয়ের সঙ্গে হাসপাতালে শেষ কথা হয়। তখন পরিবারের কাউকে চিনতে পারেনি কুলসুম। কারও কথার উত্তর দিতে পারেনি।
বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, রোজ আট থেকে দশজন প্রবাসীর লাশ আসছে। মাঝে মধ্যেই নারীর লাশ থাকছে। কিন্তু কেন, কীভাবে এই নারীরা মারা যাচ্ছেন- তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে পরিবারের। বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব লাশ আসে তার মধ্যে ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মীর। বাকিরা পোশাক কারখানা বা অন্যত্র কাজ করেন। এর মানে গৃহকর্মে ঝুঁকি অনেক বেশি। রামরু গত ৩১ জানুয়ারি ‘ডেথ অব ফিমেল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। দেশে আসা ৫৫৮ নারী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ ও করণীয় বিষয়ে ওই গবেষণায় বলা হয়, মৃত্যু সনদে যা-ই থাকুক না কেন ৪৮ শতাংশ ক্ষেত্রে স্বজনরা সেটা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু সংশ্নিষ্ট দেশ যে মৃত্যুসনদ দেয় তার বাইরে কোনো পুলিশি তদন্ত হয় না। ফলে পরিবারের আপত্তি থাকলেও তাদের কিছু করার থাকে না।
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বেগম। কিন্তু তাঁর মরদেহ পাওয়া যায় মিসরে। সৌদি থেকে কীভাবে মিসরে গিয়ে তিনি মারা গেলেন, সেই রহস্যের কোনো সমাধান হয়নি। বেগমের স্বামী আব্দুল আজিজ বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানতে পারেন, বেগম নামে এক নারী মিসরে মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী সৌদি আরবে থাকায় তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। এরপর মিসর থেকে যখন তাঁকে ফোন করা হলো, তখন বুঝতে পারেন তাঁর স্ত্রী মিসরে মারা গেছেন। কিন্তু বেগমকে তো সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। মালিক না নিলে তিনি কী করে মিসরে গেলেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর যত লাশ আসে, তার একটা বড় অংশই আসে সৌদি আরব থেকে। এ ছাড়া জর্ডান, ওমান, লেবানন, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ থেকে লাশ আসে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ নারীকর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ সাড়ে চার লাখই গেছেন সৌদি আরবে। আবার মূল সংকটটা সেখানেই।
সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের কারণে এ দেশগুলো যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে দেশটি। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল, প্রায় ছয় বছর ধরে সৌদি আরবে পুরুষ কর্মী পাঠানো বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ বারবার অনুরোধ জানাচ্ছে শ্রমবাজার চালুর কিন্তু সৌদি আরব সাফ জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী দিতে হবে। নয়তো বাজার খুলবে না।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। শ্রম বাজার চালুর জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ। ওই চুক্তির পর ২০১৫ সালে গেলেন ২১ হাজার নারী শ্রমিক। ২০১৬ সালে গেলেন ৬৮ হাজার। ২০১৭ সালে ৮৩ হাজার, ২০১৮ সালে ৭৩ হাজার, ২০১৯ সালে ৬২ হাজার, ২০২০ সালে ১২ হাজার, ২০২১ সালে ৫৩ হাজার এবং ২০২২ সালে ৭০ হাজার নারীকর্মী সৌদি আরব গেছেন।
ঢাকার উত্তর বাড্ডার এক নারী জানান, যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষরা তাঁকে শারীরিক নির্যাতন ও শ্নীলতাহানি করত। প্রতিবাদ করলে তাঁর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো। মানিকগঞ্জেরে এক নারী জানান, সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন তিনি। নির্যাতনের কারণে চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। পরে তাঁর স্থান হয় হাসপাতালের আইসিইউতে। কুমিল্লার এক নারীকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দিলে ১৪টি সেলাই লাগে। ফেরত আসা অনেক নারী নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলো শুনলে কান্নায় ভিজে যায় চোখ। গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরেছেন কেউ কেউ। কাউকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ইস্ত্রি দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শরীর। আর মৃত্যু তো আছেই।
সৌদি আরব থেকে ফেরা ফরিদপুরের সুফিয়া বেগম বলেন, ‘অনেক সময় নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে অনেকে আত্মহত্যা করেন। অনেকে নিজেকে আহত করেন। নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আমি নিজের গলায় নিজে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিলাম। অনেকেই এমন করে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নাসিরউল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামালউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জানান, ‘একজন মানুষ কখনোই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করেন না। সৌদি আরবের যে ঘটনাগুলো আমরা দেখি, এর কারণ ওই নারীরা সেখানে হয়তো নিপীড়ন বা বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হন, আত্মহত্যাকেই তিনি বাঁচার উপায় মনে করেন। আসলে মানুষ আর কোনো উপায় সামনে না পেলেই এটা করে।’
এই সংকট সমাধানে ২০১৯ সালে সরকার যে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল, তাতে বলা হয়, প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন নিশ্চিত করতে হবে। নারীকর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যথাযথ মনিটর করাসহ অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনা প্রয়োজন।
জনশক্তি প্রেরণকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সৌদি আরবে বা বিদেশে নারী নিপীড়ন কিংবা মৃত্যুর ঘটনায় অধিকাংশ সময় এজেন্সিগুলোর দিকে আঙুল তোলা হয়। কিন্তু যারা নিপীড়ন করে, বিদেশের সেই নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সংকটের সমাধান হবে না।’
বিদেশে নারী নিপীড়ন বা শ্রমিকের মৃত্যু যে কারণেই হোক, বাংলাদেশ দূতাবাস যদি সংশ্নিষ্ট দেশের পুলিশকে তদন্ত করতে বলে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাহলেই হয়তো এ ধরনের ঘটনা কমবে। প্রবাসী নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত এবং মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা চেয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। এ ছাড়া প্রবাসে মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে যথাযথভাবে জানানোর পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এতে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন নয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানে আদালতের যথাযথ নির্দেশনা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিকভাবেও বিষয়গুলো তোলা উচিত। কারণ এই নারীরা বাংলাদেশের। বিদেশে একজন বাংলাদেশি নারীর কান্না মানে পুরো দেশের কান্না। একজন নারীর নিপীড়ন মানে দেশের নিপীড়ন। এ বিষয়ে সরকারসহ সব মহলের সোচ্চার ভূমিকা জরুরি।
সূত্র: সমকাল
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post