‘ডেড সি’ নাম শুনলেই গা কেমন ছমছম করে ওঠে! মনে হয়, মৃত লোকদের এক সাগর, যেখানে ভাসছে লাশ! আসলে কিন্তু তেমনটি নয়। বরং ‘ডেড সি’ ভীষণ সুন্দর একটি জায়গা। ডেড সির পানি এতটাই ঘন যে ওই পানিতে কেউ চাইলে শুয়েও থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, পানিতে শুয়ে শুয়ে বইও পড়া যায় এখানে। কিংবা ল্যাপটপ নিয়ে গিয়ে ওখানে শুয়ে শুয়ে নেট ব্রাউজিং করা যাবে।
তবে সাগর বলা হলেও এটি মূলত একটি হ্রদ, যার সর্বোচ্চ গভীরতা ৩০৪ মিটার। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত এই মৃত সাগরের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে জর্ডান এবং পশ্চিম সীমান্তে যথাক্রমে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন। এর পৃষ্ঠভাগ ও তীরদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২৯ মিটার নিচে অবস্থিত। এই সাগরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ প্রায় ৩৪.২ শতাংশ। যা সমুদ্রের পানির চেয়েও ৮দশমিক ৬ গুণ বেশি লবণাক্ত। এই অত্যধিক লবণাক্ততার কারণে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিবেশে জলজ প্রাণীরা বসবাস ও জীবনধারণ করতে পারে না। আর তাই এই সাগরে কোনো প্রাণের বাস নাই বললেই চলে।
তবে মাছ নেই বলে যে এই হ্রদে কোনো জীবন্ত প্রাণীই নেই, তা কিন্তু নয়। এই হ্রদে বাস করে নানা রকমের ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাক। শুধু তাই নয়, এই হ্রদ অঞ্চলটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। এখানকার আবহাওয়া অনেক রোগ সারিয়ে তোলার জন্য তো ভালোই, এই হ্রদের তীর সূর্যস্নান করার জন্যও যাকে বলে একেবারে মোক্ষম জায়গা। তাই জায়গাটি দিন দিন পর্যটকের কাছেও খুবই প্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্য ভালো করতে ঘুরতে বের হন, তাদের জন্য এটা এক টুকরো স্বর্গ।
প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে। ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়। তবে পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ডেড-সি (লুত সাগর) হলো একটি অভিশপ্ত জায়গা, যেখানে হাজারো মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এক মহা-অপরাধী সম্প্রদায়কে এক মুহূর্তের মধ্যে জীবন্ত সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
জানা যায়, প্রায় ৪৫০০ বছর আগে বর্তমান ডেড-সি এলাকাটিতে তদানীন্তন বিশ্বের আর্থিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সর্বোন্নত অথচ নৈতিকতার দিক দিয়ে অধঃপতিত ও সর্বনিকৃষ্ট একটা জাতি বসবাস করত। পুরুষে-পুরুষে সমকামিতা, লুটপাট, রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদি ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। প্রকাশ্য দরবারে, মাঠে, বিভিন্ন পার্কে দিবালোকে তারা সমকামে লিপ্ত হতো। হজরত লুত (আ.) তার এই জাতিকে বিভিন্নভাবে এহেন অপকর্ম হতে বিরত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি তাদের বোঝাতে ও বিরত রাখতে পারলেন না। বরং উল্টোভাবে তার জাতি তাকে দেশ হতে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
যেহেতু তারা সমকামিতায় নিমজ্জিত ছিল তাই তিনজন ফেরেশতা, ১. হজরত জিবরাঈল (আ.), ২. হজরত ইসরাফিল (আ.) এবং ৩. হযরত মিকাঈল (আ.) কৌশলস্বরূপ সুদর্শন ছেলে মানুষের রূপ ধারণ করে ওই এলাকায় আসেন। সুদর্শন ছেলে মানুষরূপী ফেরেশতারা সন্ধ্যার পর রাতের অন্ধকারে হজরত লুত (আ.)-এর বাড়িতে পৌঁছার পরপরই হজরত লুত (আ.)-এর স্ত্রী যে কোনোভাবেই হোক বিষয়টি জানার পর সে এলাকার যুবকদের মধ্যে গোপনে তথ্যটি ছড়িয়ে দেয়।
সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুবকেরা মেহমানদের সঙ্গে সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে হজরত লুত (আ.)-এর বাড়িতে প্রবেশ করে। মেহমানদের ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে হজরত লুত (আ.) বারবার হীন অপকর্মের উদ্দেশে আসা যুবকদেরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চরিত্রহীন যুবকদল কোনোভাবেই নবীর কথায় কর্ণপাত করল না। একপর্যায়ে হজরত লুত (আ.)-এর কাছে ফেরেশতারা তাদের পরিচয় দিয়ে বলেন, রাত কিছুটা থাকতে অর্থাৎ ভোর হওয়ার আগেই হজরত লুত (আ.) যেন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান এবং কেউ যেন পেছন দিকে ফিরে না তাকায়।
তবে শর্ত ছিল, হজরত লুত (আ.)-এর পরিবারের মধ্যে হতে তার স্ত্রী সঙ্গে যেতে পারবে না, কারণ মহিলাটি তার জাতির সঙ্গে ধ্বংস হবে বলে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত ছিল। ভোর রাতে হজরত লুত (আ.) তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ভূমিকম্প শুরু হয়। ভূগর্ভ হতে পরিপক্ব মাটির প্রস্তর (ভূ-তাত্ত্বিক ভাষায়, অতি উত্তপ্ত লাভা) অবিশ্রান্তভাবে দুশ্চরিত্র জনতার ওপর বর্ষণ করা হয় এবং জমিনকে উল্টিয়ে তাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এ সময়ে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়। সাদুম, গোমরা ও আশপাশের অন্যান্য পাপিষ্ঠ নগরীর জমিনকে ভূ-গর্ভে মিশিয়ে দেওয়া হয়। যা বর্তমানে ডেড-সি বেসিন বা মৃত সাগর অথবা লুত সাগর নামে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে এই হ্রদটি মিশরের মমি তৈরির জন্য, সার উৎপাদনের জন্য পটাশসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই হ্রদ থেকে প্রাপ্ত লবণ ও খনিজ পদার্থ বিভিন্ন প্রসাধনী ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
আরো পড়ুন:
সৌদির ফুটপাতে ঘুমাচ্ছেন বাংলাদেশিরা
যুবরাজ সালমানকে সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা
ওমানে নতুন রোগের সন্ধান, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ওমান গেলেন আমিরাতের প্রেসিডেন্ট
প্রবাসীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বের অঙ্গীকার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post