আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি সম্পদশালী রাষ্ট্র হচ্ছে ওমান। প্রবাসীদের কাজের ক্ষেত্রে এই দেশটির নাম বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই শুনে থাকবে। আরব সাগরপাড়ের তেল, পাহাড় আর বালির এই দেশটির আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণ হলেও জনসংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ লাখের মতো। দেশটিতে প্রবাসীদের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে বাংলাদেশের প্রথম শ্রম বাজার সৌদি আরবের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ওমানের নাম।
মধ্যযুগের অনেক ঐতিহাসিক দুর্গ রয়েছে মরুর এই দেশটিতে। মধ্যযুগের শুরুর দিকে অর্থাৎ ১১৫৪ থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর ওমানের শাসন করেছিলো বনী নাবহান রাজবংশ। ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতে ওমান শাসিত হতো ইমামদের দ্বারা।
ইমামগণ পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিকেই জনগণের হর্তাকর্তা ছিলেন। আজ্দ গোত্রে ইয়াহমাদ শাখা নবম শতকে ওমানের ক্ষমতায় আসে। তারা এমন একটি ব্যবস্থা দাঁড় করায়, যেখানে বনী সামা গোত্রের ওলামাগণ ইমামদের নিয়োগ দেন।
উল্লেখ্য, ওমানের সবচেয়ে বড় গোত্র ছিলো নিজারী গোত্র, যার সবচেয়ে প্রভাবশালী শাখা ছিলো বনী সামা। ধীরে ধীরে ইমামরাই দেশের হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন। কিন্তু ক্ষমতার অর্ন্তদ্বন্দ্বে ইমামদের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং দেশে কার্যত কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। এ সুযোগে ওমান হস্তগত হয় সেলজুক সাম্রাজ্যের।
মধ্যযুগে আরব অঞ্চলে অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিলো সেলজুকদের। তুর্কী-পারসিয়ান সুন্নী মুসলমান সেলজুকরা পশ্চিমে ইউরোপ থেকে পূর্বে হিন্দুকুশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে। পারস্য উপসাগরের এলাকাগুলো সেলজুকদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। খ্রিষ্টীয় ১১শ ও ১২শ শতকে সেলজুকরা ওমান শাসন করেছে, ১১৫৪ সালে নাবহানদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
আরবিতে ‘নাবহান’ শব্দের অর্থ সতর্ক, সচেতন। নাবহান গোত্র একটি অপ্রধান সুন্নী মুসলমান গোত্র, যারা মূলত যাযাবর ব্যবসায়ী ছিল। গোত্রের বিচক্ষণ এবং অভিজ্ঞ কিছু ব্যক্তি ছোট ছোট কাফেলা তৈরি করে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল স্কাউট করত এবং বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে মূল ক্যাম্পে ফিরে আসত। এরপর ব্যবসায়ীরা কিছু দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কোন পণ্য কোথায় ভালো পাওয়া যায়, সেটা তারা জানত এবং সেখান থেকে এনে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগান দিত। ব্যবসা শেষে তারা আবার তাদের গোত্রের সাথে মিলিত হতো এবং নতুন কোনো জায়গায় চলে যেত।
পারস্য উপসাগরনাবহানিরা ছিল খুবই বিচক্ষণ, সৎ এবং পরিশ্রমী ব্যবসায়ী। ভবিষ্যৎ হিসাব-নিকাশ এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে তারা খুবই দক্ষ ছিল। ফলে পরবর্তী সময়ে তারা ওমানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী শাসক হতে পেরেছিল। ব্যবসার সুবিধা বিবেচনা করে তারা দক্ষিণ ওমানে গিয়ে স্থায়ী হয়।
একপাশে সাগর, অন্যপাশে সৌদি আরব ও ইয়েমেন, আরেক পাশে রাজধানী মাসকাট থাকায় তারা দোফার নামক প্রদেশে গিয়ে স্থায়ী বসতি তৈরি করে। বর্তমানে দোফার ওমানের বৃহত্তম প্রদেশ। তবে দোফারে স্থায়ী হওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল লোবান। পৃথিবীতে লোবানের প্রধান উৎস ছিলো দোফার এবং মধ্যযুগে লোবানের আকাশচুম্বী চাহিদা ছিল। এই লোবানের একচেটিয়া ব্যবসা করেই বনী নাবহানের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।
লোবান (Frankincense) একধরনের সুগন্ধি, যা প্রধানত আতর এবং আগরবাতি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অনেকেই পড়ে থাকবেন। মধ্যযুগে এই লোবান নিষিদ্ধ তো নয়ই, বরং ব্যাপক চাহিদার পণ্য ছিল। কারণ ইসলামি শাসনের সূর্য তখন মধ্যগগণে; আতর তথা সুগন্ধির চাহিদা ও প্রসার তখন বিশ্বব্যাপী।
সুগন্ধি তেল হিসেবেও লোবান গাছের নির্যাস ব্যবহৃত হতো, যার চাহিদা ছিলো সার্বজনীন। লোবান তাই অনেক দামি পণ্য হিসেবে পরিগণিত হতো; এমনকি সবচেয়ে উন্নতমানের লোবান সিলভার ও হাজারি উৎপন্ন হতো মূলত দোফারে।
নাবহানিরা সোহার বন্দর হয়ে বাহরাইন, বাগদাদ, দামেস্কসহ আরবের লোবানের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। এভাবে বনী নাবহান গোত্র প্রচুর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করে। বিদেশী শাসনে অসন্তুষ্ট ওমানের জনগণের মধ্যে বনী নাবহান গোত্রের নেতা মুহাম্মদ আল-ফাল্লাহ ১১৫১ সালে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং ১১৫৪ সালে সেলজুকদের বিতাড়িত করে ওমানের শাসনভার হাতে তুলে নেন। তিনি ১১৭৬ সাল পর্যন্ত ওমান শাসন করেন।
নাবহানিদের আগে পর্যন্ত ইমাম খেতাবধারি নামমাত্র শাসক বিদ্যমান ছিল। নাবহানিরা মুলুক বা সুলতান খেতাবে ওমান শাসন করতেন। ১৪০৬ সালে ইমাম মুসা বিন আবু জাফর মারা যাওয়ার পর ইমাম খেতাব তখনকার মতো বিলুপ্ত হয়ে যায়।
নাবহানি শাসকদের রাজধানী ছিল বাহলা, যা মাসকাট বন্দরের খুব কাছেই। যেহেতু নাবহানিদের মূল শত্রু ছিল পারস্য উপসাগর পেরিয়ে হামলাকারী হরমুজ সাম্রাজ্য বা সেলজুকরা, তাই নাবহান শাসকদের দেশের বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করতে হয়েছিল।
১৫ শতকে এসে নাবহান শাসকদের প্রতিপত্তি কমে যেতে শুরু করে এবং ইমামদের পুনরুত্থান ঘটে। ১৫ শতক হতে ১৭ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ওমানে একজন নির্বাচিত ইমাম এবং একজন নাবহান বংশীয় সুলতান যৌথভাবে ক্ষমতায় থাকেন।
১৫০৭ সালে পর্তুগিজরা মাসকাট, সোহার ও পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় এলাকা দখল করে নেয়। এর ফলে নাবহান ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পারস্য অঞ্চলগুলোতে পাঠাতে সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে এবং পর্তুগীজরা দক্ষিণের সূর বন্দর দখল করে নিলে নাবহান শাসকরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
এ সুযোগে ১৫২৯ সালে, ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাইল নাবহানি সুলতান সুলাইমান বিন মুদাফফর রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচে ক্ষমতাবিহীন নামমাত্র সুলতানে পরিণত হন। কিন্তু ইমামগণের শাসনকার্যে অযোগ্যতার কারণে ওমান খুব দ্রুত পর্তুগিজদের দখলে চলে যায়।
১৬২৪ সালে ইয়ারুবা শাসক নাসির বিন মুরশিদ পর্তুগিজদের কাছ থেকে ওমান দখল করে নেন। বনী নাবহান গোত্র এরপর বনী রাওয়াহাহ এবং বনী রিয়াম গোত্রের সাথে একীভূত হয়ে যায় এবং সম্মিলিত গোত্রের নাম হয় ‘বনী রিয়াম’, যার তামিমাহ বা প্রধান ছিল বনী নাবহান গোত্রের।
ইয়ারুবা শাসনামলে তারা পর্বতবেষ্টিত জাবাল আল-আখদার রাজ্য গড়ে তোলে এবং ওখানেই বসবাস করতে থাকে। এরপর ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশদের মদদে ওমানের সুলতান সাইদ বিন তৈমুরের বিরুদ্ধে নির্বাচিত ইমাম গালিব আলহানির গৃহযুদ্ধ বাঁধে।
এ যুদ্ধে অন্যান্য আরব দেশের পাশাপাশি বনী রিয়ামের শেখ সুলাইমান বিন হিমইয়ার আল-নাবহানি ইমামদের পক্ষ নিয়ে ১৯৫৬-৫৭ সালে জাবাল আল-আখদারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সৌদি আরবে নির্বাসিত হন এবং ১৯৯৮ সালে মারা যান।
পরবর্তীতে ২৯ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পিতা সাঈদ বিন তাইমুরকে সরিয়ে ১৯৭০ সালে সুলতান হয়ে বসেন কাবুস। সুলতান কাবুস ১৯৭০ সালে যখন ওমানের সিংহাসনে আরোহন করেন তখন দেশটিতে মাত্র ১০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা আর তিনটি স্কুল ছিল।
কৃষক আর জেলেদের দেশ হিসেবে পরিচিত ওমানে তখন অবকাঠামো বলতে তেমন কিছু ছিল না। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ওমান তখন দারিদ্র্য পীড়িত একটি দেশ। কিন্তু সেই গরিব ওমান আজ আরব বিশ্বের একটি আধুনিক ধনি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।
উন্নত অবকাঠামো আর নাগরিকদের স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য ওমান অন্যতম সুখী আর শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। ওমানের আজকের যত পরিচিতি তার মুলে রয়েছেন সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ।
ক্ষমতা আরোহণের পরপরই কাবুস মনোনিবেশ করেন ওমানের তেল সম্পদ ব্যবহারের দিকে। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ওমানকে টেনে বের করে আনলেন বিশ্ব দরবারে।
অশিক্ষিত জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে তিনি মনোযোগ দিলেন শিক্ষায়। গড়ে তুলতে লাগলেন দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের অবকাঠামো। তেলের আয় দিয়ে গড়তে লাগলেন রাস্তা ঘাট, নদী বন্দর, বিমান বন্দর, হাসপাতালসহ নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
বিদ্যুৎ, টেলিকমিউনিকেশনসহ সব দিক দিয়ে দেশকে একটি শক্ত অবকাঠামো ও ভিত্তির ওপর দাড় করালেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও তিনি উৎসাহিত করলেন । ফলে গড়ে উঠতে লাগল ব্যাংক, হোটেল, ইনস্যুরেন্স, পর্যটন অবকাঠামোসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান।
ওমানকে আজকের একটি উদার, আধুনিক আর ধনি রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছানোর জন্য গোটা বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসকে পরিণত হন সুলতান কাবুস। ৭৯ বছর বয়সে ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
মৃত্যুর পর আলোচনায় এসেছেন আরব বিশ্বের নিভৃতে থাকা এ শাসক।একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসতেন প্রায়ই এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতেন। অনেক সময় তিনি নিজেই নিজের গাড়ি চালাতেন। ক্ষমতায় বসে ওমানকে একটি আধুনিক উদার আর ধনি রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন কাবুস। অনেকে একে রেনেসাঁর সাথে তুলনা করে থাকেন।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সরকারব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্র খুব জোরালো থাকলেও কাবুসের কোনো সন্তান বা ভাই না থাকায় সরাসরি পরিবারতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা কার্যকরের কোনো সুযোগ ছিল না ওমানে। কাবুস মৃত্যুর অনেক আগেই তার উত্তরসূরি নির্বাচন করে একটি চিঠি লিখে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরই সে চিঠিটি খোলা হয়েছিল। তাতেই হাইতাম বিন তারিককে সুলতান হিসেবে মনোনীত করার নির্দেশনা পাওয়া যায়। প্রয়াত সুলতানের সে নির্দেশনার বিরোধিতা করেননি কেউই।
ওমানে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সুলতানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে। ওমানের সুলতান একই সাথে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার এবং প্রতিরক্ষা, অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। নতুন সুলতান হাইতাম দায়িত্ব নেয়ার পর তার প্রথম ভাষণে বলেছেন, তিনি তার পূর্বসূরির ধারাই চালু রাখবেন। কারণ ওমানের লোকজন এই পররাষ্ট্রনীতিতেই খুশি। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংঘাত থেকে দূরে থাকা এবং বিভিন্ন সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার ভূমিকায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দেশটির বর্তমান সুলতান হাইথাম বিন তারেক।
তথ্য সূত্রঃ রোর মিডিয়া
আরো পড়ুন:
ওমানে বাড়লো প্রবাসীদের ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ
ওমানে মর্মান্তিক পাহাড়ধসে আরো এক প্রবাসীর মরদেহ উদ্ধার
তুরস্কের হায়া সোফিয়ায় ৮৮ বছরে প্রথম তারাবি হতে চলেছে
হিজাব ইস্যুতে মেয়েদের টার্গেট করা হচ্ছে: মিস ইউনিভার্স
প্রবাসীদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া শুরু
রমজানে ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাসে নতুন অফিস সূচি
ওমানে পাথর ধ্বসের পর এবার মাটিধসে এক প্রবাসী নিহত
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post