রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য সুখবর! দেশে ফেরা যেসব প্রবাসী কর্মী নানাবিধ আর্থ-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত, তাদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক (পিকেবি) অভিবাসী ঋণের সুদের হার ৮%-এ নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা এ বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হবে। বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের সহায়তা করার জন্য ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি ঋণ প্রদানের পদ্ধতিকেও সহজ করবে।
দেশের রেমিট্যান্স আয় গত কয়েক মাস ধরে কমে আসার প্রবণতায় রয়েছে। এমন সময় বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য ঋণকে ঝামেলামুক্ত এবং সস্তা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, অভিবাসী শ্রমিকরা দেশে ফেরার পর তাদের স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত (পুনঃএকত্রীকরণ) হওয়ার সহায়তা দিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি নীতি কাঠামো প্রস্তুত করছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জীবন বীমা কর্পোরেশন এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত সকল বাংলাদেশিদের কর্মস্থলে মৃত্যু ও আহত হওয়াকে তাদের প্রবাসী কর্মী বিমা স্কিমের আওতায় আনতে সৌদি আরবের একটি কোম্পানির সাথে আলোচনা শুরু করে।
প্রবাসী কর্মীদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের রিজার্ভকে করেছে সমৃদ্ধ, যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেয়েছে বাহ্যিক আর্থিক অভিঘাতগুলি সহ্য করার ক্ষমতা। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারিতে এই প্রবাসীরাই সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কাতারে এসে পড়ে। এসময় তাদের মধ্যে কয়েক লাখ বিদেশে কর্মসংস্থান হারিয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়।
পিকেবির ম্যান্ডেটে রয়েছে প্রবাসীদের ঋণদান, এই সংস্থাকেই আর্থিক দুরাবস্থার শিকার প্রবাস ফেরত কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু, তাদের উদ্যোগ থেকে লক্ষ্যকৃত সুবিধাভোগীরা খুব কমই উপকৃত হয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিকেবি থেকে সহজ ঋণ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন, যাতে বিদেশে চাকরি-সন্ধানীদের এবার ভিটেমাটি, জমিজমা বেচে না যেতে হয়।
চলতি বছরের গত ৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত স্বচ্ছ করতে এবং বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের সঠিক নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষ ও দেশের বাইরে যাওয়ার মোট খরচের ব্যাপারে জানাতে বৃহৎ পরিসরে গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানোর নির্দেশ দেন।
পিকেবি চেয়ারম্যান আহমেদ মুনিরুস সালেহীন বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে, আমরা অভিবাসন ঋণের প্রক্রিয়া সহজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথম পর্যায়ে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নীতিগতভাবে সুদের হার ৯% থেকে কমিয়ে ৮% করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
জাতীয় পুনঃএকত্রীকরণ নীতি
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অসামান্য অবদান থাকা সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসেননি দেশে ফিরে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন সংকটে পড়া প্রবাসীরা। সরকার এখন এসব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই লক্ষ্যে একটি “বিস্তৃত জাতীয় পুনঃএকত্রীকরণ নীতি” প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নাসরীন জাহান বলেন, তার মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে নীতিমালাটি নিয়ে কাজ শুরু করেছে, যা হবে সার্বজনীন প্রকৃতির।”নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে মতামত চাওয়া হচ্ছে। তার আগে সুশীল সমাজের সদস্য, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেওয়া হবে,” তিনি যোগ করেন।
তিনি আরো জানান, কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য এই বছরের মধ্যে নীতি প্রণয়ন সম্পন্ন করার, এর পরে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। সরকারের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের অধীনে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে বা তাদের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে- মহামারির মধ্যে দেশে ফিরে আসা দুই লাখ অভিবাসীকে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বিশ্বব্যাংক এজন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছে । ওয়েজ অনার্স কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, দেশের ৩২ জেলা থেকে এই দুই লাখ প্রত্যাগত প্রবাসীর তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
দুর্বল প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর তথ্য অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৮ লাখ চার হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত ছিলেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক মাত্র ৭৭ হাজার ঋণপ্রত্যাশীকে ১,২০০ কোটি টাকার অভিবাসন ঋণ প্রদান করে। ব্যাংক সূত্র অনুযায়ী, রিকভারি রেট বা ঋণ আদায়ের হার ৮৬ শতাংশ যা দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় ঋণ আদায় হারের দ্বিগুণ। অন্যদিকে, দেশে ফিরে আসা অভিবাসীদের চার শতাংশ হাতে রিইন্টিগ্রেশন বা পুনঃএকত্রীকরণ ঋণ পাওয়ার কথা থাকলেও ঋণ প্রদান সন্তোষজনক নয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার দেশে ফেরত কয়েক হাজার অভিবাসীর পুনর্বাসনের দিকে মনোযোগ দিলেও তাদের মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ পিকেবি থেকে পুনঃএকত্রীকরণ ঋণ পায়।
এদিকে, পিকেবির মহাব্যবস্থাপক মো: জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সরকারের ৭০০ কোটি টাকার বিশেষ পুনঃএকত্রীকরণ ঋণ তহবিল থেকে চলতি বছরের ৯ মার্চ পর্যন্ত দেশে ফেরত ১১,৪৯৫ জন অভিবাসীর মাঝে ব্যাংকটি ৩১২ কোটি ৩২ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। তবে ফেরত আসা অভিবাসীদের অনেকেই অভিযোগ করেন যে, পুনঃএকত্রীকরণ ঋণের জন্য নির্ধারিত শর্তাবলী যেমন হওয়ার কথা, তেমন সহজ নয়।
এদিকে, নতুন ভিসার ক্ষেত্রে একজন অভিবাসী সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ঋণ পেতে পারেন। এছাড়া ব্যাংকের খুব বেশি শাখাও নেই। যেগুলো আছে সেখানেও নেই পর্যাপ্ত জনবল। বর্তমানে সারা দেশে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ৮৯টি শাখা রয়েছে।
আরএমএমআরইউ-এর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার বলেন, “ব্যাংকের শাখার সংখ্যা বাড়ালেই ঋণ বিতরণ বাড়বে না। সরকারের উচিত অন্য ব্যাংকগুলোকেও একই ধরনের ঋণ প্রকল্প পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া, যাতে মানুষ সহজে ঋণ পায়।”
আরো পড়ুনঃ
কাতারে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন বাংলাদেশি নিহত
ওমানের সালালায় এক বাংলাদেশী প্রবাসীর আত্মহত্যা!
ভ্যাকসিনের নতুন তালিকা প্রকাশ করলো ওমানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রম বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান
ওমান যেতে ভিসা লাগবে না কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের
৮ দিন বন্ধ থাকার ফের চালু হলো ই-পাসপোর্টের অনলাইন আবেদন
ওমানে বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post