মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশি মানেই কর্মী হিসেবে আয় রোজগার করা অভিবাসী। মেধা ও পরিশ্রম দ্বারা প্রচলিত সেই ধ্যান-ধারণা পাল্টে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুর ইউনিয়নের উত্তর হরিহরপুর গ্রামের মৃত কারির উদ্দীনের ছেলে যুবক মিজান।
ভাগ্য চক্রে ১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়ে মিজান নিমার্ণ শ্রমিক হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। মেধা, পরিশ্রম, দক্ষতা দিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন সাফল্যের দিকে, তারপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মিজান এখন মালয়েশিয়ার ১ম শ্রেণির শিল্পপতি, গড়ে তুলেছেন একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান, পেয়েছেন দেশটির রাজা কর্তৃক প্রদত্ত সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মানিত খেতাব ‘দাতো’। এই খেতাব মালয়েশিয়ায় শুধুমাত্র বিশিষ্টজনরাই পেয়ে থাকেন।
‘দাতো’ মিজান মালয়েশিয়ায় গড়ে তুলেছেন বৃহৎ গ্রুপ প্রতিষ্ঠান মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্স। পরিস্থিতির কারণে স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি মিজান কিন্তু বর্তমানে তার অধীনেই কাজ করছেন মালয়েশিয়ার সিভিল বিএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারসহ উচ্চ শিক্ষিতরা।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ‘দাতো’ মিজানের কোম্পানিতে বেশির ভাগই শ্রমিক রয়েছেন বাংলাদেশি। মিজান গ্রান্ড ইন্টার ট্রেডার্সের অধীনে সরকারি ও বেসরকারি ৮টি নির্মাণ সেক্টরে প্রায় শতকোটি টাকার কাজ চালু রয়েছে। দাতো মিজান ইতিমধ্যে কলিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনার জন্য দূতাবাসের কাছে চাহিদাপত্র জমা দিয়েছেন।
‘দাতো’ মিজানের এই আকাশচুম্বী সাফল্যে যে কেউ বিস্মিত হতেই পারেন। কিন্তু পাশাপাশি শূন্য হাতে মালয়েশিয়ার একজন নির্মাণ শ্রমিক থেকে ‘দাতো’ মিজান সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণের কাহিনী হতে পারে বাংলাদেশিদের জন্য একটি আদর্শ। লাখ লাখ প্রবাসী ও বেকার যুবকদের মধ্যে কর্ম উৎসাহ জাগানোর জন্য ‘দাতো’ মিজানের জিরো থেকে হিরো হওয়ার কর্মজীবনের নীতি আদর্শই যথেষ্ট।
অভাবের সংসার ছিল মিজানের। পাঁচ ভাই ও ছয় বোনসহ মোট ১৩ সদস্যের পরিবার তাদের। অভাবের কারণে অন্যের বাড়িতে কাজ করে বাবাকে সহযোগিতাও করেছেন মিজান, অভাবের কারণে পড়ালেখাও তেমন করতে পারেননি। ১৯৯০ সালে কাউকে না জানিয়েই পাড়ি জমান ঢাকায়, এরপর ১৯৯৬ সালে ঠাঁই নেন মালয়েশিয়ায়।
‘দাতো’ মিজান বুঝেছিলেন দ্রুত উন্নতি করার অবস্থানে যেতে ব্যবসা হতে পারে সেরা মাধ্যম। তাই তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে কুয়ালালামপুর থেকে ৫৫০ কি.মি দূরের কেলান্তান প্রদেশে চলে আসেন। কিন্তু বিধিবাম, সেখানে তিনি স্বদেশির মাধ্যমে প্রতারণা ও পুলিশ হয়রানির শিকার হন। পরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি কেলান্তানে প্রায় শূন্য হাতে একটি কনস্ট্রাকশন সাইটে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইভাবে তিন বছর কেটে যায়।
মিজান নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করলেও নিজের দক্ষতা ও পরিশ্রমে তিনি আজ এই সেক্টরের শীর্ষ স্থানটি দখল করেছেন। ফলে এই তিন বছরে অনেক শ্রমিক তার অধীনে কাজ করা শুরু করে। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময় কেলান্তান প্রদেশের আর্থিক অবস্থাও বেশি ভালো ছিল না, সেখানকার জনসংখ্যা ছিল খুব কম। তারপরেও মিজানের উন্নতি ও অগ্রগতি থেমে থাকেনি।
‘দাতো’ মিজান মালয়েশিয়ায় বিয়ে করেন। বর্তমানে তিনি পাঁচ সন্তানের জনক। তিনি মালয়েশিয়ার সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক তারাভূমি জি-০৭ লাইসেন্স প্রাপ্ত। বর্তমানে যা মালয়েশিয়ায় মিজান গ্রান্ড ইন্টার ট্রেডার্স এসডিএন বিএইচডি নামে পরিচিত। বর্তমানে তার বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট ক্যামেরুন, থাইল্যান্ডসহ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে। আরও রয়েছে গরু ও ছাগলের আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত খামার। স্থাপন করেছেন কৃষি খামার, তাছাড়া আরও বিভিন্ন প্রজেক্ট চালুর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, এইভাবে তিনি কেলান্তানের একজন সফল বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। ব্যবসায়ী সফলতার জন্য মালয়েশিয়ার কুয়ান্তানের রাজা সম্মানসূচক ‘দাতো’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
‘দাতো’ মোহাম্মদ মিজান জানান, জীবনে বড় হতে হলে কঠোর পরিশ্রমী হতে হয়। সততা ও নিষ্ঠা থাকলে জীবনে বড় হওয়া যায়। পৃথিবীতে আজ যারা সফল হয়েছেন তারা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফল হয়েছেন। আমি বাংলাদেশি হিসেবে খুব গর্ব করি এবং বাংলাদেশিদের জন্য কাজ করা অব্যাহত আছে। সেই সঙ্গে মালয়েশিয়ার দেয়া ‘দাতো’ উপাধি বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post