বিমানবন্দরে প্রবেশকালেই দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ অপেক্ষার প্রহর ১০-১২ ঘণ্টাও পেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই বিমানবন্দর এলাকার অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় গ্রহণ করতে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসী কর্মীদের। এসব খাবার ও পানীয় খেয়ে ফ্লাইট চলাকালে উড়োজাহাজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তাদের অনেকে। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন গন্তব্যে গিয়েই। বিষয়টির মাত্রা এতটাই বেড়েছে, সম্প্রতি এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ইউএই ও কাতার দূতাবাস। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরাও। এমনকি এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাতে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকায় দিনে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসী কর্মীদের। যাত্রার ছয় ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষা করতে হচ্ছে ইউএইগামী কর্মীদের। আবার বিমানবন্দরে প্রবেশের সময়ও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। বাড়তি যাত্রীর চাপে করোনা সনদ পরীক্ষা, বোর্ডিং কার্ড ও ইমিগ্রেশনেও লম্বা লাইন। এ অবস্থায় ফ্লাইট ধরতে পারবেন না, এমন আতঙ্কে বিদেশগামী কর্মীদের বেশির ভাগই বিমানবন্দরে আসছেন যাত্রার ১০-১২ ঘণ্টা আগে। আর্থিক সংগতি না থাকায় অপেক্ষার এ দীর্ঘ সময়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে রওনা দেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাওয়া শ্রমিকরা ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমি ও কলেরাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বেশকিছু শ্রমিক উড়োজাহাজের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। গন্তব্যস্থলে গিয়ে বিমানবন্দরে বা কাজে যোগ দেয়ার পরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, মহামারীর প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বহির্বিশ্বে এখন বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। তবে এর মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয়টি দেশের শ্রমবাজার নিয়ে নতুন করে আশঙ্কা তৈরি করছে।
বিশেষ করে দুটি গন্তব্যের বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যে এ অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি। দেশ দুটি হলো ইউএই ও কাতার। এই দুই দেশেরই দূতাবাস থেকে সম্প্রতি এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি উদ্বেগের। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দুটি রোগকে খুবই ভয় পায়। একটি হলো যক্ষ্মা, আরেকটি কলেরা। এখানে শ্রমিকদের মধ্যে কলেরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ লক্ষণ আরো দেখা গেলে তারা হয়তো শ্রমবাজারই সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেবে।
ইউএই ও কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে চিঠি পাওয়ার পর বিষয়সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে অবহিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে এরই মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। সেখানে কিছু দিকনির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে যারা বিদেশ যাবেন তারা বাংলাদেশ থেকে খাবার নিতে পারবেন না।
ধারণা করা হচ্ছে, বিমানবন্দরের আশপাশের হোটেল, রেস্তোরাঁ ও সেখানকার পানি থেকেই জীবাণু ছড়াতে পারে। এরই মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনকে বিষয়টি বলা হয়েছে। তারা সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বিদেশগামী প্রবাসী কর্মীরা অধিকাংশই আসেন ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে। করোনা পরীক্ষাসহ নানা কারণে যাত্রার অনেক আগেই তারা ঢাকায় আসেন। যাত্রাপথে বা ঢাকায় আসার পর তারা যেসব জায়গার খাবার খেয়ে থাকেন, সেখানে কোনো সমস্যা থাকতে পারে। আবার বিমানবন্দরে এসেও অনেকে আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলোর খাবার খান, যা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যকর নয়। অনেকে আবার খাবার নিয়েও বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। যেকোনো জায়গা থেকেই সমস্যাটি তৈরি হতে পারে। এ কারণে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে যারা বিদেশ যাবেন, তারা বাংলাদেশ থেকে খাবার নিতে পারবেন না।
প্রসঙ্গত, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সংস্কারকাজ চলছে। এজন্য প্রতিদিন রাত ১২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত সব ফ্লাইট বন্ধ রাখা হচ্ছে। এ অবস্থা চলবে আগামী ছয় মাস। এতে বিমানবন্দরের ফ্লাইট পরিচালনা কার্যক্রমে বিপর্যয় নেমে এসেছে। যাত্রীচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে ইউএই সরকারের শর্ত অনুযায়ী, গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে যাত্রার ৬ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে যাত্রীদের করোনা পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। করোনা পরীক্ষা করাতে এসেও তাদের দীর্ঘ লাইনের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
আবার রাতে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় যাদের সকালে ফ্লাইট রয়েছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারা বাধ্য হয়ে অনেক আগেই এসে উপস্থিত হচ্ছেন বিমানবন্দরে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে বিমানবন্দরে অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা যায়। বিমানবন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এসব যাত্রীকে রাত কাটাতে হচ্ছে টার্মিনালেই। তাদের বেশির ভাগকেই খাওয়া-দাওয়া করতে হচ্ছে বিমানবন্দরের আশপাশের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো থেকে, যার অধিকাংশই অস্বাস্থ্যকর।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম আকতারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, বিদেশগামী প্রবাসী কর্মীরা অর্থাভাবের কারণেই বিমানবন্দরের আশপাশের ছোট রেস্টুরেন্টগুলো থেকে খাবার খাচ্ছেন। তারা যে পানি খাচ্ছেন, সেটিও জীবাণুমুক্ত নয়। অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় খেলে তার প্রভাব মূলত ৫ থেকে ২০ ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যায়। এ কারণে কেউ কেউ উড়োজাহাজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বাকিরা গন্তব্যে পৌঁছে অসুস্থ হচ্ছেন। বিদেশীগামী কর্মীদের উচিত এসব খাবার না খেয়ে ভালো কোম্পানির রুটি ও কলা খাওয়া। এজন্য বেশি অর্থও ব্যয় হয় না। দুই ঘণ্টা পর পর কলা খেলে পেট যেমন ভরা থাকে, তেমনি শক্তিও পাওয়া যায়। পাশাপাশি চেষ্টা করতে হবে বোতলজাত মিনারেল পানি খাওয়ার।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, বিমানবন্দরসহ সর্বত্রই ভেজাল ও নিম্নমানের খাবারের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। বিমানবন্দরের বাইরের রেস্তোরাঁগুলোয়ও আমাদের অভিযান চলমান আছে। ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া গেলে জরিমানা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমরা কাউকে ছাড় দিই না। সূত্রঃ দৈনিক বনিক বার্তা
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post