ভবন তৈরি হয় ব্যবহারের জন্য। সেই ভবনটি যদি দৃষ্টিনন্দন হয় তখন তা মানুষকে মুগ্ধ করে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে ভবনটির নির্মাণশৈলী। প্রজন্মের অনেক নান্দনিক চিন্তায় গড়ে উঠে এমনই কিছু মনোমুগ্ধকর স্থাপনা। তেমনই একজন প্রজন্মের মেধাবী স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। তার স্থাপত্যশৈলী বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশকে আত্মস্থ করে হয়ে উঠেছে আধুনিক।
মুসলিম বিশ্বে অনন্য মসজিদ স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নান্দনিক নিদর্শন হিসেবে বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশে অবস্থিত লাল মসজিদ। সম্প্রতি মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-সালাম সম্মেলন হলে আয়োজিত এক রাজকীয় জমকালো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ী স্থপতি কাশেফ চৌধুরীর পক্ষে ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র গ্রহণ করেন সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
আবদুল লতিফ ফৌজান আন্তর্জাতিক মসজিদ স্থাপত্য শিল্প বিষয়ক অ্যাওয়ার্ডের তৃতীয় সেশনের এবারের আয়োজনে গোটা মুসলিম বিশ্ব থেকে সাতটি মসজিদ স্থাপত্য শিল্পের অনন্য সাধারণ নিদর্শন হিসেবে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে- সৌদি আরব, মিসর, লেবানন, ইন্দোনেশিয়া, মালে ও তুরস্ক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের হাতে সম্মাননাপত্র ও ক্রেস্ট তুলে দেন অ্যাওয়ার্ড ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রিন্স সুলতান বিন সালমান এবং মদিনা রিজিওনের গভর্নর প্রিন্স ফয়সাল বিন সালমান।
প্রজন্মের মেধাবী স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী স্থাপত্যশৈলী স্থাপত্যধারার এক অনন্য। তিনি প্রকৃতি, মানুষের চিরায়ত সংস্কৃতির ধারা ও বিশ্বাসকে সমন্বয় করেন নিজের কাজে। স্থাপত্য-কর্মে কাশেফ স্পেস ব্যবহার, উপকরণ নির্বাচন সবকিছুই বৈশ্বিক ও দেশীয় ধারার সমন্বয়ে সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সে কারণেই তার স্থাপত্য-কর্মগুলো সারা বিশ্বের স্থাপত্যবিদদের নজর কেড়েছে।
প্রকৌশলি বাবার ছেলে কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর বেড়ে ওঠা মূলত বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে স্থাপত্য বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৬ সালে সিডনির ‘গ্লেন মারকাট মাস্টার ক্লাস’-এ অংশগ্রহণ করেন। স্থপতি উত্তম কুমার সাহার সাথে কিছু দিন কাজ করে তিনি ১৯৯৫ সালে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ‘আরবানা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০৪ সাল থেকে তিনি ‘আরবানা’র প্রধান স্থপতির দায়িত্ব পালন করছেন। স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যকলা বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে স্বাধীনভাবে স্টুডিওভিত্তিক চর্চা করেন তিনি। পাশাপাশি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
এছাড়া, ২০১২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের সমালোচনায় জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দুবার আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। সম্প্রতি কাশেফ চৌধুরী আর্কিটেকচারাল রিভিউজ এআরডি এমার্জিং আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড-২০১০-এ প্রথম স্থান লাভ করেছেন। স্থাপত্যশিল্পীর পাশাপাশি একজন পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেন তিনি।
সহকর্মীদের সঙ্গে ভীষণ আন্তরিক তিনি। এ কারণে সহকর্মীরা সবাই নিজের প্রতিষ্ঠানের মতোই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অফিসে নতুন কেউ যোগ দিলে মজার একটা নিয়ম পালন করতে হয় তাকে। নিজের হাতে রান্না বান্না করে খাওয়াতে হয় সবাইকে। মেধাবী স্থপতি কাশেফ নিজেও রান্না করতে ভালোবাসেন।
কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে নিজেই করেন দারুন সব মজাদার রান্না বান্না। হয়তো তাই এই ব্যতিক্রমী নিয়ম। এ ছাড়া সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ। ব্যস্ততা তাকে দেয় না কোনো অবসর। ব্যস্ততা শুধু স্থাপত্য ভাবনা নিয়েই। চিন্তার গভীরে গেলে বাহ্যিক সব কিছু ভুলে যান। ভাবনায় ধরা দেয় একের পর এক অনিন্দ্য স্থাপত্য শৈলী। আবাসিক ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং অফিস কমপ্লেক্স, স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র সহ বিচিত্র ধরনের কাজ করেছেন তিনি।
বরাবরই ছিল তার মৌলিক কিছু করার প্রয়াস। আর তাই তো সমাদৃত হয়েছেন বহুবার। ২০১৬ সালে গাইবান্ধায় অবস্থিত সৌন্দর্য মন্ডিত ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্যের জন্য কাশেফ মাহবুব চৌধুরী জিতে নিয়ে ছিলেন বিশ্ব খ্যাত ‘আগা খান’ পুরস্কার। সবুজ বাংলার এই অপূর্ব স্থাপনা দিয়ে কাশেফ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বয়ে এনেছিলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অকুণ্ঠ প্রশংসা আর বিরল সম্মান।
তার সাথে ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদ স্থাপত্যের জন্য স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমও আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আরেক খ্যাতিমান স্থপতি সাইফ উল হক স্থানীয় সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে সাশ্রয়ী, স্থিতিশীল ও পরিবেশ বান্ধব এক স্থাপনা ‘আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট’ নির্মাণ করে আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার পান।
আগাখান স্থাপত্য পুরস্কার স্থাপত্যের দুনিয়ায় অত্যন্ত সম্মানজনক। এমন কি এর আগেও স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী আগা খান পুরস্কারের মনোনয়নও পেয়েছিলেন দুবার। ২০০৪ সালে স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে যৌথ ভাবে করা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের জন্য।
২০১০ সালে চট্টগ্রামের নিভৃত গ্রামে করা চাঁদগাঁওয়ে নির্মিত একটি মসজিদের জন্য মনোয়ন পান কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। ভারতের সারা জাগানো জে কে সিমেন্ট অ্যাওয়ার্ড এবং সারা বিশ্বে খ্যাত ‘আগাখান’ অ্যাওয়ার্ড বাংলাদেশে এসেছে একাধিকবার। দেশের মেধাবী স্থপতিদের হাত ধরে তাদের সৃষ্ট স্থাপত্যের গুণগত মানের জন্য। স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে স্থাপত্যের চর্চা এবং বিকাশ, দেশের ও গুণী স্থপতিদের কাজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারুণ ভাবে স্বীকৃত। তাদের মেধার স্বীকৃতিতে যে অর্জন তা দেশেল ভাবমূর্তিকে অধিকতর উজ্জল করে তুলছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post