বাংলাদেশের হাতিয়া ও সন্দ্বীপ এলাকার ৫০ হাজারের বেশি জেলে ওমান সাগরে ভাসমান জীবন কাটান। এটি আনুমানিক একটি হিসাব। কারণ প্রকৃত হিসাব কারও কাছেই নেই। এই মানুষগুলো তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে এক দিন আমির হয়ে দেশে ফিরবেন এমন আশায় ঘরবাড়ি, গরু–মহিষ বেঁচে ওমানে গিয়েছিলেন।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় আমির তো দূরের কথা অনেকের লাশও খুঁজে পায়নি তার পরিবার! আরব সাগরে ঝড়ের কবলে প্রাণ হারিয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে ভেসে যাচ্ছে এই প্রবাসীদের দেহ?
মরুর দেশ ওমানে কয়েকদিন আগেই ভয়াল ঘূর্ণিঝড় শাহীন আঘাত হেনেছিল। এই ঝড়ের খবরে বাংলাদেশের অসংখ্য পরিবারে চুলা জ্বলেনি। অনেক পরিবারে হয়তো চিরস্থায়ী স্বাদ আহ্লাদ হারিয়ে গেছে।
ওমান সরকারের হিসাবে এই ঘুর্ণিঝড়ে ১৪ জন মানুষ মারা গেছেন। যার চারজন বাংলাদেশি। তারা সবাই লক্ষ্মীপুর জেলার বাসিন্দা। কিন্তু বাস্তবে মৃত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলে জানিয়েছে ওমানের বিভিন্ন গণমাধ্যম। কারণ ঝরের পর এখন পর্যন্ত অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। এসব মরদেহ ওমান সাগরের ইরান উপকূলে ভেসে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
বেওয়ারিশ এসব লাশের মধ্যে যে অনেক বাংলাদেশিও রয়েছেন এ বিষয়ে সন্দেহ একেবারেই নেই। কারণ ওমান সাগরে মাছ ধরার শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করেন তাদের বড় অংশই বাংলাদেশি। এর আগে ২০১৮ সালের এক রাতে ঘূর্ণিঝড় মেকুনু আঘাত হেনেছিল ওমানের সালালাহ শহরে। ৩ মাত্রার সেই ঝড়ে অনেক হতাহত মানুষের মধ্যে বাংলাদেশিরাও ছিলেন।
২০১০ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘ফেত’ ওমানের পূর্ব উপকূল তছনছ করে দেয়। ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন ‘গনু’তে হতাহত মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। যার একটি বড় অংশই ছিল বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক। তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত আজও জানা যায়নি। হয়তো সমুদ্রের গভীর লোনা জ্বলে তাদের দেহাবশেষ হারিয়ে গেছে।
কিন্তু দেশে তাদের পরিবারের কি অবস্থা এই খবর কে নিয়েছে? তাদের চোখের লোনা জল যেন ওমান সাগরের জলের মতো স্বাদহীন লবণাক্ত হয়ে গেছে। ওমানের মরুভুমিতে যারা বাস করেন তাদেরকে বেদুঈন বলা হয়। একসময় এই বেদুঈনদের কাজ ছিল মরুভুমি ভেড়া চরানো। সত্তরের দশকে যখন ওমান তেলের খনির সন্ধান পায় তখন দেশটির ভাগ্য খুলে যায়।
তার আগে ওমানের মানুষের মূল পেশা ছিল সমুদের মাছ ধরা। তেল খনি পাওয়ার পর ওমানের শাসকরা সিদ্ধান্ত নেন মাছ ধরার ঝুঁকিপূর্ণ পেশা তারা বেদূঈনদের হাতে ছেড়ে দেবেন। কিন্তু মরুর বেদুঈন কি আর সহজে পানিতে নামে? তা দেয়া হয় লোভনীয় অফার। অর্থাৎ, মাছের আড়তের মালিকানা ছেড়ে দেয়া হয় তাদের হাতে।
এই সুযোগে অনেক ভারতীয় আর পাকিস্তানি ব্যবসায়ী বেদুইনদের কাছ থেকে নৌকা ইজারা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তবে ওমান সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, মাছ ধরার কাজে কেউ বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করতে পারবে না। তবে দোকান কর্মচারী বা গৃহকর্মী অথবা ভুয়া অফিসকর্মী, এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মী আনা যাবে। এই সুযোগে অসৎ ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে মাছ ধরার কাজ করায়। যারা মূলত সমুদ্রেই থাকেন।
উপকুলে খুব একটা আসে না। আবার পাচারের শিকার হয়ে অনেকে করাচি হয়ে চোরা নৌপথে ওমানে গিয়ে আটকে গিয়েছেন এই মাছ ধরার জালে।এই জাল–ক্রীতদাসদের মজুরির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মাছ পেলে মজুরি, না পেলে নেই। মাছ পেলে মজুরি ঠিক হয় সেদিন বাজারে ওই মাছের দরের ওপর।
যেহেতু নৌকা আর সাগরপাড়ের অস্থায়ী ঝুপড়ি ছাড়া এই জাল–ক্রীতদাসেরা পুলিশের ভয়ে কোথাও যেতে পারেন না, তাই বাজারের হালহকিকত দর দাম তাঁদের জানা থাকে না। ফলে মালিক যে দাম বলেন সেটাই মজুরদের মেনে নিতে হয়। লিজ নেওয়া ভারতীয়-পাকিস্তানিদের ভিড়ে দু-একজন বাংলাদেশি ভাগ্যবান ক্যাপ্টেনও আছেন। তবে নিষ্ঠুরতা আর প্রতারণায় কেউ কারও থেকে কম নয়।
মাস্কাটে অবস্থিত ওমান দূতাবাস ধরা খাওয়া এসব মানুষের অস্তিত্বই স্বীকার করে না। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আইনি সহযোগিতা দূরে থাক, হাসপাতাল বা জেলখানায় গিয়ে দেখা করা বা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার কোনো রেওয়াজ নেই।
দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মতে, যেহেতু কাগজে-কলমে জেলে হিসেবে ওমান বাংলাদেশ থেকে কোনো জনশক্তি আমদানি করে না, তাই সেখানে কোনো জেলে থাকতে পারেন না বা নেই। বৈধ কাগজপত্র হাতে না থাকায় পুলিশের ভয়ে ঝড়ের সময়ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোথাও যেতে পারেনা এসব হতভাগা শ্রমিক।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post