বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত টানা তিন বছরে মোট ৩৪ লাখ ৫২ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়ে উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন করেছে।
২০২৪ সালে মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৫৬ জন কর্মী বিদেশে গেছেন, যা বার্ষিক হিসাবে দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। গত বছর দেশে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণও রেকর্ড ২৬.৮৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)।
২০২৪ সালে বিদেশে কর্মসংস্থান ২০২৩ সালের তুলনায় ২২ শতাংশ কমলেও কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় সংখ্যাটা এখনো অনেক বেশি। করোনাকালে বার্ষিক শ্রম অভিবাসনের সংখ্যা ৬-৭ লাখের মধ্যে ঘোরাফেরা করত।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১৩.০৫ লাখ অভিবাসী কর্মী পাঠিয়ে ছিল। ২০২২ সালে সংখ্যাটি ছিল ১১.৩৫ লাখ। প্রথমবারের মতো বছরে ১০ লাখ কর্মী পাঠানোর মাইলফলক অর্জিত হয় ২০১৭ সালে।
তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, প্রতারণা, বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং অব্যবস্থাপনা যদি যথাযথভাবে মোকাবিলা করা না হয়, তাহলে এই প্রবৃদ্ধি স্থায়ী না-ও হতে পারে। বাংলাদেশ যদি বৈদেশিক শ্রমবাজারে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে চায়, তবে সুশাসন নিশ্চিতকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ ও দক্ষ কর্মী পাঠানোর প্রবণতা বাড়ানোই হবে ভবিষ্যতের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
তথ্য পর্যালোনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালে সৌদি আরব সর্বোচ্চ ৬ লাখ ২৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়েছে, যা একক বছরে কোনো দেশের জন্য সর্বোচ্চ সংখ্যা। শুধু ডিসেম্বরেই সৌদি আরবে ৮৬ হাজার ৮৬৬ জন বাংলাদেশী কর্মী গেছেন, যা ৪৭ মাসের মধ্যে মাসিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ নিয়োগ।
তবে এই সাফল্যের মাঝেও কাজ না পাওয়া এবং প্রতারণা-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে। ২০২৪ সালে প্রতারিত অভিবাসীদের কাছ থেকে ৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ পেয়েছে বিএমইটি। তাদের বেশিরভাগই সৌদি আরবে ভুয়া চাকরির প্রস্তাব এবং ইকামা-সংক্রান্ত (কাজের আবাসিক অনুমতি) সমস্যায় পড়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সমস্যার মূল কারণ অবৈধ ভিসা বাণিজ্য। এর ফলে বাজারের চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত শ্রমিক সরবরাহ হয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রতারণামূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ২৪টি সৌদি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এসব কোম্পানিকে বাংলাদেশী এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সৌদি আরবের ওপর বাংলাদেশের অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। ২০২৪ সালে বিদেশগামী মোট শ্রমিকের ৬২ শতাংশ গেছেন এই উপসাগরীয় দেশে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ার, অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, গন্তব্য দেশের বাংলাদেশী দূতাবাসের শ্রম শাখাগুলো যদি নিয়োগকারীদের সামর্থ্য যাচাই করতে ব্যর্থ হয় এবং চাকরির নিশ্চয়তা ছাড়াই কর্মীদের পাঠানো হয়, তবে সৌদি আরবের মতো দেশগুলো থেকে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে। তিনি আরও বলেন, নতুন বাজার উন্মুক্ত হলে বাংলাদেশ ও গন্তব্য দেশের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলো প্রায়ই বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠায়।
তবে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই না হলে বিশৃঙ্খলা এবং নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি তৈরি হয়। বাজার বহুমুখীকরণের প্রয়োজনীয়তা ॥ বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসন কিছু নির্দিষ্ট দেশে সীমাবদ্ধ আছে। ২০২৪ সালে ৯০ শতাংশ কর্মী গেছেন মাত্র ছয়টি গন্তব্যে তথা সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডান। আর গত পাঁচ বছরে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মীরা মাত্র দশটি দেশে গেছেন।
নিওম সিটি ও রেড সি প্রকল্পের মতো সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর মেগাপ্রকল্পগুলো বেশ কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা নির্ভরতা কমাতে বাজার বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের বাজার ফের চালুর পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলোতে নতুন সুযোগ খুঁজতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভুয়া চাকরির প্রস্তাব ঠেকাতে বাংলাদেশি দূতাবাস ও রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
দক্ষ ও নারী অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ ॥ অদক্ষ অভিবাসন বৃদ্ধি এবং দক্ষ অভিবাসন কমে যাওয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২৪ সালে অদক্ষ কর্মী অভিবাসন আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে দক্ষ কর্মীদের অভিবাসন কমেছে ২ শতাংশ।
এ ছাড়া নারী অভিবাসনও এক দশকের মধ্যে (করোনা মহামারিকালীন সময় বাদে) সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৫৪ হাজার ৬৯৬ জন নারী কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যা এই সময়ের মোট অভিবাসনের মাত্র ৬.০৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর নারী কর্মীদের অভিবাসন কমেছে ২২ শতাংশ।
রামরুর গবেষণায় উঠে এসেছে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ অনেক নারীকেই বিদেশে কাজের সুযোগ নিতে নিরুৎসাহিত করেছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post