বাঁচার জন্য আমাদের প্রয়োজন শ্বাস-প্রশ্বাস। কিন্তু যদি এক মুহূর্তের জন্য সেই শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়? ঠিক তখনই জীবন হয়ে পড়বে বিপন্ন! শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে মানবদেহের একটি অঙ্গ। আর শরীরের সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির নাম ফুসফুস। ফুসফুসকে মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালু রেখে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে এই যন্ত্র। এর প্রধান কাজ হলো বাতাস থেকে অক্সিজেনকে রক্তপ্রবাহে নেওয়া এবং রক্তপ্রবাহ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বাতাসে নিষ্কাশন করা। ফুসফুসে থাকা ডালপালার মতো অসংখ্য ছোট নালির মাধ্যমে বাতাস হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মানবদেহের শরীরে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের অবস্থান পাশাপাশি। তাই হৃৎপিণ্ডকে ভালো রাখার জন্য ফুসফুসকেও সুস্থ রাখা অনেক জরুরি।
ফুসফুসকে প্রাণীদেহের চালিকাশক্তি বলা হয়ে থাকে। ধূমপান না করা, ব্যয়াম করা,বায়ুদূষণ এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি ফুসফুসকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো খাদ্যতালিকায় রাখলে ফুসফুসকে ভালো রাখতে সহায়তা করবে। ভিটামিন-এ, ভিটামিন সি ও ভিটামিন-ই ফুসফুসের জন্য মহৌষধ। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটিকে সুস্থ রাখতে যত্নবান হতে হবে। ফুসফুস শক্তিশালী রাখার কিছু প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া: শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া যা সবচেয়ে সহজও। প্রতিদিন ‘‘ইয়োগা’’ বা যোগব্যায়াম করাও এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে।
নিয়মিত শরীরচর্চা: সব ধরনের শরীরচর্চাই শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতা বাড়ানোসহ ফুসফুসের জন্য অনেক উপকারী। এজন্য নিয়মিত সাঁতার কাটা, দৌড়ানো, ট্রেকিং ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করা দরকার।
প্রচুর পানি পান করা: শরীরের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে পানির ভূমিকা অপরিসীম। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করলে শরীরে রক্ত চলাচলের মাত্রা বাড়ে এবং ফুসফুস আর্দ্র ও ভালো থাকে। তাই ফুসফুসকে ভালো রাখতে প্রচুর পানি পান করা উচিত।
কড়া গন্ধযুক্ত খাবার (রসুন, পেঁয়াজ) খাওয়া: অনেকসময় বিরক্তিকর মনে হলেও কড়া গন্ধযুক্ত খাবার যেমন রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি খেলে দেহে তা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে যা ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টিতে বাধা দেয়। তাই নিয়মিত এসব মশলাজাতীয় খাবার খাওয়া যেতে পারে।
লেবুজাতীয় ফল খাওয়া: প্রতিদিন লেবুজাতীয় ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এধরনের ফলে থাকে ভিটামিন “সি” যা ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহে সাহায্য করে। এছাড়া, অন্যান্য খাবার যেমন- ক্যাপসিকাম, বাদাম, আদা, কুমড়া, গাজর, দুধ ফুসফুসের প্রদাহ ও রোগ প্রতিরোধ কার্যকর।
বসার ভঙ্গি: আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্স-এর গবেষণা অনুযায়ী সোজা হয়ে না বসে শরীর কুঁচকে বা দুমড়ে মুচড়ে বসলে কিংবা সারাক্ষণ আধশোয়া হয়ে বসলে ফুসফুসকেও কুঁকড়ে রাখে ও দীর্ঘদিন এমন অভ্যাস বজায় রাখলে তা ফুসফুসের খাঁচাকে ছোট করে দেয়।
ফ্যাটি ফিশ : ফ্যাটযুক্ত মাছগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার যা ফুসফুসের জন্য উপকারী। কারণ তাদের মধ্যে ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিডগুলির উচ্চ মাত্রা থাকে যা ফুসফুসকে ভালো রাখতে সহায়তা করবে।
আপেল : আপেলে ফ্লাভোনয়েড নামের এমন এক উপাদান থাকার ফলে এটি শ্বাসনালীর সিস্টেমকে ভালো রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও আপেল ভিটামিন-সি, ই এবং বিটা ক্যারোটিনের উচ্চ মাত্রার সাথে যুক্ত থাকার ফলে এটি ফুসফুসকে সুস্থ্য রাখে।
ব্ল্যাক কফি : কফি ফুসফুসকে ভালো রাখতে সহায়তা করে বিশেষ করে ব্ল্যাক কফি। কফি পান করার পর শ্বাসতন্ত্রের কার্যক্রম আরো বেশি ভালো হয়। তাই ফুসফুসকে সুরক্ষিত রাখতে কফি পান করতে পারেন।
গ্রিন -টি : অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরা গ্রিন-টি ফুসফুস সংক্রমণের আশঙ্কা কমায়। প্রতিদিন গ্রিন-টি পান ফুসফুসকে পরিষ্কার করে। এছাড়া গ্রিন-টি অন্ত্রের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে।
এছাড়াও আনারসের জুস এবং লেবুর শরবত প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন।আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন-সি। এই দুটি উপাদান প্রাকৃতিকভাবেই ফুসফুসকে পরিষ্কার করে। লেবুর শরবত খেলে ফুসফুস শক্তিশালী হয় এবং বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়।
শ্বাসের ব্যায়াম: ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়াতে প্রতি দিন শ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে। ফিটনেস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে ডায়াফ্রাগমাটিক ব্রিদিং, পার্শড লিপস ব্রিদিং ইত্যাদির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে ফুসফুসের পেশি শক্ত হওয়ার পাশাপাশি এর বাতাস ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ে।
এছাড়াও, ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে হলে-
– ধূমপান পরিহার করতে হবে।
– বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। বাড়ির ছাদে ফুলের টবে গাছ লাগিয়ে হলেও এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া যায়।
– নিয়মিত ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকা জরুরি।
– বাড়িঘর থেকে গুমোটভাব দূর করতে হবে।
– মাঝে মাঝে লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উঠলে পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। এতে হৃৎপিণ্ডের পাশাপাশি ফুসফুসেরও কার্যক্ষমতা বাড়ে।
আরও পড়ুনঃ লিভার ভালো রাখতে ৫ খাবার
– উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পারিবারিকভাবে ফুসফুস ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে।
– যক্ষ্মা, হাঁপানি বা ফুসফুসের অন্য কোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
ফুসফুসের কাজ অবিরাম চলতে থাকে, কখনোই এর বিশ্রাম নেই। এই সুন্দর পৃথিবীতে ভালোভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে ফুসফুসের সুস্থতা অপরিহার্য। তাই চলুন ফুসফুস সুরক্ষিত রাখতে একটি সুস্থ জীবনধারার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং নিজের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নানান জটিলতা থেকে মুক্ত রাখি।
লেখকঃ উম্মে হাফসা ইভা,
খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী
https://www.youtube.com/watch?v=PPGE5o2wIPA
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post