কোনো দেশের শীর্ষ নেতাকে হত্যা করা কেবল একটি শোকের ঘটনা নয়; এমন ঘটনায় অনেক বিতর্ক, রহস্য ও ষড়যন্ত্র থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চারজন প্রেসিডেন্ট আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন—আব্রাহাম লিংকন, জেমস এ. গারফিল্ড, উইলিয়াম ম্যাককিনলি এবং জন এফ. কেনেডি। যদিও এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে নথিভুক্ত, তবুও প্রতিটি হত্যার পেছনের উদ্দেশ্য আজও অমীমাংসিত।
১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিংকনকে হত্যা করা হয়েছিল সিভিল ওয়ারের পরপরই, যখন দেশটি পুনর্মিলনের পথে ছিল। লিংকন ছিলেন জাতীয় ঐক্য ও আশার প্রতীক। তাঁর খুনি জন উইলকস বুথ ছিলেন একজন বিখ্যাত অভিনেতা ও কনফেডারেট সমর্থক। তিনি বিশ্বাস করতেন লিংকনকে হত্যা করে দক্ষিণের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে ঘটনাটি আরও জটিল ছিল। বুথ একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন, যেখানে অন্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদেরও হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে অনেকে মনে করেন, এর পেছনে আরও গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
জেমস গারফিল্ড, যিনি হয়তো অনেকের কাছে অপরিচিত, প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাত্র চার মাস পর ১৮৮১ সালে আততায়ীর গুলিতে আহত হন। চার্লস গুইটো নামের এক ব্যক্তি তাকে গুলি করেন, যিনি বিশ্বাস করতেন তিনি একটি সরকারি পদ পাওয়ার অধিকারী। যদিও গুইটোকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে মনে করা হয়েছিল, তৎকালীন রাজনীতির ভেতরের বিভাজন ও দুর্নীতিগ্রস্ত নিয়োগ ব্যবস্থা গারফিল্ডকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পেছনে চিকিৎসাজনিত ভুলও ছিল। ডাক্তাররা জীবাণুমুক্ত না করে তার শরীরে আঙুল ঢুকিয়ে ক্ষত পরীক্ষা করেছিলেন, ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, সঠিক চিকিৎসা পেলে তিনি বেঁচে যেতে পারতেন।
আরও পড়ুন
১৯০১ সালে উইলিয়াম ম্যাককিনলিকে হত্যা করেন লিয়ন চোলগোস, একজন উগ্র নৈরাজ্যবাদী যিনি রাষ্ট্রপতির নীতিকে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক হিসেবে দেখতেন। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের মাধ্যমে ম্যাককিনলি আমেরিকাকে একটি নতুন বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু এই উত্থান সবাই মেনে নিতে পারেনি। একটি মেলার সময় ম্যাককিনলিকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। চোলগোস নিজে দোষ স্বীকার করলেও তাঁর বিচার ও মৃত্যুদণ্ড দ্রুত সম্পন্ন হয়েছিল, যা সন্দেহের জন্ম দেয়—কেউ কি চেয়েছিল ঘটনাটি দ্রুত ধামাচাপা দিতে?
তবে সবচেয়ে রহস্যময় ও বিতর্কিত হত্যাকাণ্ডটি ছিল জন এফ. কেনেডির। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর ডালাসে একটি খোলা গাড়িতে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। সরকারিভাবে বলা হয়, লি হার্ভি অসওয়াল্ড এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু মাত্র দুই দিন পর অসওয়াল্ডকেও গুলি করে হত্যা করা হয়, তাও আদালতে পৌঁছানোর আগেই। এই ঘটনা জনমনে ব্যাপক সন্দেহ সৃষ্টি করে। অসংখ্য তদন্ত ও ওয়ারেন কমিশনও এসব সন্দেহ দূর করতে পারেনি। সাক্ষীদের ভিন্নমত, রহস্যজনক ভিডিও ফুটেজ এবং হারিয়ে যাওয়া প্রমাণ—সব মিলিয়ে শত শত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয়। কেউ বলে সিআইএ, কেউ বলে মাফিয়া বা কিউবার নির্বাসিতদের হাত ছিল এতে। আজও, এত বছর পর, এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ সত্য অজানা।
এই চারটি হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না, বরং এগুলো আমেরিকার ভেতরের আদর্শগত সংঘাত, ক্ষমতার লড়াই ও সামাজিক অস্থিরতার প্রতিফলন। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে—তারা কেউই নিজেদের অপরাধী মনে করেনি। বরং তারা বিশ্বাস করত তারা কোনো মহৎ আদর্শের জন্য কাজ করছে। কিন্তু তারা কি একা ছিল, নাকি কোনো বড় শক্তির হাতের পুতুল ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।