চলতি বছরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক সমর্থন দেওয়ার পর পুরো নির্বাচন পরিস্থিতিই বদলে যায়। ইলন মাস্কের মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একজন ধনকুবেরের সমর্থন যেকোনো অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান, প্রতিপাদ্য ও এর এজেন্ডা বাস্তাবায়নে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’ প্ল্যাটফর্মকেই ব্যবহার করেননি, বরং লাখ লাখ ডলার ব্যয় করার পাশপাশি পেশীশক্তিও ব্যবহার করেছেন।
কত টাকা ঢেলেছেন মাস্ক
নির্বাচনি প্রচারের সময় নিজের সর্বস্ব উজার করে ট্রাম্পের পাশে ছিলেন ইলন মাস্ক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরের তথ্যমতে, টেসলার নির্বাহী অন্তত ১৩২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন ট্রাম্পের নির্বাচন উপলক্ষে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের মধ্যে ৭৫ মিলিয়ন ডলার সরাসরি ব্যয় করেছেন ট্রাম্পের প্রচারের পেছনে। মাস্ক এই অর্থ ব্যয় করেছেন নিজেরই প্রতিষ্ঠিত আমেরিকা পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির (পিএসি) মাধ্যমে।
তাই মাস্কের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কালক্ষেপণ করেনি ট্রাম্প। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বিজয় সমাবেশের বক্তৃতায় ইলন মাস্কের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এই রিপাবলিকান নেতা। তিনি মাস্ককে ‘নতুন তারকা’, ‘সুপার জিনিয়াস’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন।
টাকা পয়সা খরচ করার পাশাপাশি তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটর্ফ এক্সকেও শক্তিশালী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন ইলন মাস্ক। ২০২২ সালে মাস্ক যখন ৪৪ বিলিয়ন ডলারে এক্স (তখন নাম ছিল টুইটার) কিনে নেন, তখন জনপ্রিয় পডকাস্ট তারকা জো রোগানসহ আরও অনেক মানুষ এটিকে ‘বোকামি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, মাস্কের ওই পদক্ষেপ মোটেও বোকামি ছিল না।
টুইটারকে নিজের কব্জায় নেওয়ার পরই এর নাম পাল্টে ‘এক্স’ রাখেন মাস্ক। তারপর ট্রাম্পের স্থগিত অ্যাকাউন্ট নতুন করে চালু করেন এবং ট্রাম্পের বক্তব্য প্রচারে এক্সকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। অনেক সমালোচকের অভিযোগ, মাস্কের এক্স প্ল্যাটফর্ম ট্রাম্পের পক্ষে বহু অপতথ্য, গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করেছে।
ট্রাম্পের পক্ষে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করেছিল এক্স
নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের পক্ষে ‘বয়ান’ তথা ন্যারেটিভ তৈরিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে এক্স। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ দাবি করেছে, এক্সের অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা ডানপন্থীদের বিষয়বস্তুকে সমর্থন করে। এই অ্যালগরিদমের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ট্রাম্পপন্থীদের পোস্টকে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
এই ভার্চুয়াল মাধ্যমে ট্রাম্পের প্রচারণায় সরাসরি কোমর বেঁধে নেমেছিলেন ইলন মাস্ক নিজে। তিনি নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিনিয়ত ট্রাম্পের পক্ষে পোস্ট দিয়েছেন।
মাস্কের অ্যাকাউন্টে ফলোয়ারের সংখ্যা ২০০ মিলিয়নেরও বেশি। এই বিপুল সংখ্যক অনুসারীদের সামনে মাস্ক সব সময় ট্রাম্পের পক্ষে ইতিবাচক পোস্ট দিয়েছেন, লাইভ অলোচনা অনুষ্ঠান করেছেন, অভিবাসন ও মূল্যস্ফীতিবিষয়ক ট্রাম্পের নীতি ও প্রতিশ্রুতিগুলো বারবার শেয়ার করেছেন।
আরেক প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, ট্রাম্পের মালিকানাধীন ট্রুথ সোশ্যালের চেয়ে মাস্কের এক্স অনেক বেশি শক্তিশালী। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রেখেছে এক্স প্ল্যাটফর্ম।
আর ব্লুমবার্গ বলেছে, আমেরিকার জনগণকে ট্রাম্পের দিকে পরিচালিক করতে ইলন মাস্ক তাঁর এক্স প্ল্যাটফর্মকে কতটা গভীরভাবে ব্যবহার করেছেন, তা হয়তো পুরোপুরি জানা যাবে না। তবে এক্স যে ট্রাম্পের পক্ষে বিপুলভাবে কাজ করেছে, তা তো দৃশ্যমানই।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় মাস্কের কী লাভ
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় মাস্কের জন্য সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে গেছে বলে মনে করে ব্লুমবার্গ। মার্কিন এই সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার খবর প্রকাশের পরপরই টেসলার শেয়ার মূল্য ১২ শতাংশ বেড়ে গেছে। এতে মাস্কের মোট সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত ১২ বিলিয়ন ডলার।
ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। এতে মাস্কের টেসলা থেকে স্পেসএক্স—সব ব্যবসাই অচিরেই ফুলেফেঁপে উঠবে।
এ ছাড়া মার্কিন প্রশাসনের ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি’–এর প্রধান হিসেবে ইলন মাস্ককে নিয়োগ দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে মাস্কের যত ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য রয়েছে, সেগুলোর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমবে।
মাস্ক ও এক্সের নতুন অধ্যায়ের শুরু
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইলন মাস্ক হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করলে, রাজনীতির ময়দানে এক্স প্রধান খেলোয়াড় হয়ে উঠবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের এক্স অ্যাকাউন্ট (সাবেক টুইটার) যতটা নীতিমালাজনিত বাধা–বিপত্তির মধ্য দিয়ে গেছে, এখন তার শূন্য শতাংশও বাধাগ্রস্ত হবে না। ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য–উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা বাস্তবায়নে এক্সকে ব্যবহার করতে শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবেন।
আমেরিকার রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব আগে অতটা প্রকটভাবে পরিলক্ষিত না হলেও এখন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ব্লুমবার্গ বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে এক্স এরই মধ্যে তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
প্রযুক্তি কীভাবে রাজনীতির ময়দানে মাফিয়া হয়ে উঠতে পারে, তা এবারের নির্বাচনে চাক্ষুস দেখিয়ে দিয়েছে ইলন মাস্ক ও এক্স। ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে হলেও মাস্ক কেন টুইটার কিনতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, তা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট।
মাস্কের পরিকল্পনা শুরুর দিকে আঁচ করা যায়নি। অনেকেই মনে করেছিলেন, টুইটার কিনতে চাওয়া খেয়ালি মাস্কের আরেকটি খেয়ালি খায়েস। কিন্তু এটি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ট্রাম্প টুইটারকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেই সেটি কিনেছিলেন। সন্দেহ নেই, ভবিষ্যতে আমেরিকার রাজনীতিতে এক্স আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তবু আছে বাধা, আছে বিপত্তি
মার্কিন শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য রয়েছে। ফলে ট্রাম্প মানেই ক্ষমতার সর্বেসর্বা নন। মাস্ককে ট্রাম্পের কাছ থেকে সুবিধা নিতে হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে মাস্ককে সমঝোতা করেই চলতে হবে। এটি একটি চ্যালেঞ্জ বটে। মাস্কের প্রধান ব্যবসা টেলসার বৈদ্যুতিক গাড়ি ও পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তি। এসব ব্যবসা নিয়ে খোদ আমেরিকাতেই সমালোচনা রয়েছে। এই সব ‘সকল কাঁটা ধন্য করে’ ট্রাম্প তাঁর ব্যবসাকে কতটা ফুলে ফেঁপে তুলতে পারবেন, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
এ ছাড়া চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতিটা বেশ আক্রমনাত্মক। সেই আক্রমনাত্মক নীতি মাস্কের টেসলাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ চীনের বাজারে টেসলার বিশাল প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post