যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোতে লটারির মাধ্যমে ভোটারদের ১০ লাখ ডলার করে বিলি করছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। তবে এই কার্যক্রম বেআইনি হতে পারে জানিয়ে তাঁকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (ডিওজে)।
ট্রাম্প শিবিরের জন্য মাস্কের রাজনৈতিক কার্যক্রম কমিটি ‘আমেরিকা প্যাকের’ কাছে এক চিঠি পাঠিয়ে এই বার্তা দিয়েছে ডিওজে। তবে মার্কিন বিচার বিভাগ কখন প্যাককে চিঠি পাঠিয়েছে—তা স্পষ্ট নয়। ডিওজের তদন্ত কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়েছেন। তবে এটি ডিওজের পাবলিক ইন্টিগ্রিটি বিভাগ পাঠিয়েছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ড নির্বাচনে ইলন মাস্ক কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে টেসলা ও এক্সের মালিক মাস্ক এক পিটিশনে (আরজিতে) সই করলেই আমেরিকান ভোটারদের পুরস্কার দিচ্ছেন। এই পিটিশন তৈরি করেছে মাস্কের প্রচারশিবির আমেরিকা পিএসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করতেই গড়ে তোলা হয়েছে এ প্রচারশিবির।
বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজসহ মার্কিন আউটলেটগুলো গতকাল বুধবার জানিয়েছে, চিঠিটি মাস্কের দলকে জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে এভাবে টাকা বিলানো ফেডারেল নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করতে পারে।
মার্কিন আইন অনুসারে, ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের নিবন্ধন করিয়ে টাকা দেওয়া বেআইনি। তবে মাস্কের চতুর পদক্ষেপ কোনো আইন ভঙ্গ করে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছয়টি অঙ্গরাজ্য—জর্জিয়া, নেভাডা, অ্যারিজোনা, মিশিগান, উইসকনসিন ও নর্থ ক্যারোলাইনায় ‘বাক্স্বাধীনতা ও অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষে’ করা পিটিশনটিতে সই করার জন্য ভোটারদের উৎসাহ জোগাচ্ছে আমেরিকা পিএসি।
কোনো ভোটার পিটিশনে সই করলে বা তিনি অন্য কোনো ভোটারকে সই করাতে পারলে প্রত্যেকে পাচ্ছেন ৪৭ ডলার। ভোটারপ্রতি তুলনামূলক বেশি অর্থ দেওয়া হচ্ছে পেনসিলভানিয়ায় (১০০ ডলার করে)। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের ভাগ্য নির্ধারণে চূড়ান্ত ভূমিকা রাখতে পারে এ রাজ্যের ফলাফল।
আমেরিকা পিএসি বলছে, যাঁরা পিটিশনে সই করছেন, তাঁরা মার্কিন সংবিধানের প্রথম ও দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রতি নিজেদের সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
এ কার্যক্রমের অধীন ৫ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগপর্যন্ত প্রতিদিন দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর একটিতে পিটিশন স্বাক্ষরকারীদের একজন এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার পাবেন।
লটারি ঘরানায় প্রথম বড় চেকটি হস্তান্তর করা হয় ১৯ অক্টোবর পেনসিলভানিয়ার এক টাউন হলে একটি অনুষ্ঠানে।
গত মঙ্গলবার সাবেক রিপাবলিকান প্রসিকিউটরদের একটি দল ডিওজেকে চিঠি লিখে মাস্কের এই প্রতিযোগিতার তদন্ত করার জন্য কর্মকর্তাদের আহ্বান জানান। তাঁরা বলেছেন, ‘আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা এমন কিছু আগে দেখিনি। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নির্বাচনের আগে পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক, তবে ভোটদান প্রক্রিয়াকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে এমন আইনগত বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাস্ক এর আগে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আপনি যেকোনো রাজনৈতিক দলের হতে পারেন এবং আপনাকে ভোটও দিতে হবে না।
এদিকে গত রোববার প্যাক প্রতিযোগিতার নিয়ম পুনর্বিন্যাস করে নতুন কৌশল নিয়েছে। তাঁরা এখন ১০ লাখ ডলারকে পুরস্কারের পরিবর্তে কাজের পারিশ্রমিক বলছে। প্যাক বলেছে, বিজয়ীকে ‘আমেরিকা প্যাকের মুখপাত্র হিসাবে ১০ লাখ ডলার দেওয়া হবে। এটি তার উপার্জন। বিজয়ীরা ট্রাম্পপন্থী বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করেছেন।
বেশ কয়েকজন আইনবিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, প্রতিযোগিতাটি অবৈধ হতে পারে। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক পল শিফ বর্মণ বলেন, ‘আমি মনে করি, মাস্কের এ ধরনের প্রস্তাব সম্ভবত অবৈধ।
নিজ বক্তব্যের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী আইনের বিধি তুলে ধরেন শিফ বর্মণ। বিধিতে বলা হয়েছে, ভোট দেওয়া বা দিতে সম্মত হওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি যদি অর্থ দেন বা এর প্রস্তাব দেন কিংবা অর্থ নেন, তিনি ১০ হাজার ডলার জরিমানা বা পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের সম্মুখীন হবেন।
আইনের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘তাঁর (মাস্ক) প্রস্তাব শুধু নিবন্ধিত ভোটারদের জন্য প্রযোজ্য। তাই আমি মনে করি, বিধি মোতাবেক এ প্রস্তাবে ঝামেলা আছে।’
এ সম্পর্কে ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের (এফইসি) বক্তব্য চাওয়া হয়। কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাস্কের নেওয়া কৌশলে ফাঁক আছে। কেননা, কাউকে নিবন্ধন করতে বা ভোট দিতে সরাসরি অর্থ দেওয়া হচ্ছে না।
ব্র্যাড স্মিথ নামের সাবেক এই কর্মকর্তা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘প্রস্তাবের কিছু জায়গায় অস্পষ্টতা রয়েছে; যার ভিত্তিতে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে (বৈধতা–অবৈধতা বিষয়ে) পৌঁছানো সম্ভব নয়। কেননা, কাউকে ভোট দিতে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য তিনি অর্থ দিচ্ছেন না। তিনি একটি পিটিশনে সই করার জন্য অর্থ দিচ্ছেন।’
কিন্তু নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির নির্বাচনী আইনের অধ্যাপক মাইকেল ক্যাং বিবিসিকে বলেন, ওই প্রস্তাব বৈধ না অবৈধ, সেটি নির্ধারণে এটির প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝছি, কিছু বিশ্লেষক এটি অবৈধ মনে করছেন না। তবে, আমি মনে করি, এ প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট পরিষ্কার। এর লক্ষ্য, লোকজনকে ভোট দিতে এমন এক পন্থার আশ্রয় নেওয়া, যা আইনগতভাবে সমস্যা সংকুল।’
এ বিষয়ে নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পেইন লিগ্যাল সেন্টারের আদাভ নোতির মত, ‘মাস্কের ওই উদ্যোগ আইনের লঙ্ঘন। এটি বিচার বিভাগের দেওয়ানি বা ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় পড়ে।’
নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব লর অধ্যাপক জেরেমি পল বিবিসিকে বলেন, ‘মাস্ক আইনি ফাঁকফোকরের সুবিধা নিচ্ছেন।’
এদিকে, পেনসিলভানিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নর জোশ শ্যাপিরো ইলন মাস্কের তৎপরতাকে ‘গভীর উদ্বেগের’ বলে বর্ণনা করেন এবং এ ব্যাপারে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তদন্তের দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ ধনী মাস্কের হৃদ্যতার সম্পর্ক। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের ব্যাপারে ক্রমেই বেশি অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন তিনি।
২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে মাস্ক ঘোষণা করেন, তিনি ডেমোক্র্যাটদের বর্জন করছেন। সে সঙ্গে নিজের অনুসারীদের রিপাবলিকান পার্টিকে ভোট দিতে উৎসাহ জোগান।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post