মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর গ্রামের অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান রফিকুল ইসলাম। নব্বইয়ের দশকে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে পুলিশে যোগদান করেন। বিশাল পরিবারের প্রয়োজন পূরণেই হিমশিম খেতে হতো তাকে। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গুলশানে। এরপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাবশালী এবং পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বদান্যতায় সম্পদ আর ক্ষমতায় ফুলেফেঁপে ওঠেন। একনাগারে গুলশানেই চাকরি করছেন ১৫ বছর। গুলশানে থাকা অবস্থায়ই বাগিয়েছেন ওসি, এসি এবং এডিসির পদ। দেশ-বিদেশে গড়েছেন বিপুল সম্পদ। গুলশান এলাকার অলিগলি থেকে শুরু করে পাঁচতারকা হোটেলেও অবাধ ক্ষমতা ছিল এই পুলিশ অফিসারের।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি-অ্যাডমিন) রফিকুলের শেষ রক্ষা হয়নি। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে ২০১৩ সালে বালু ও ময়লার ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করার ঘটনায় ৪ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সদস্য মো. শরীফুল ইসলাম বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। ওই মামলায় গুলশান থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুক্রবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গুলশান থানার এসআই রায়হানুল ইসলাম সৈকত তার ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি দেওয়া হয়। কর্মসূচিতে খালেদা জিয়া যাতে অংশ নিতে না পারেন, সেজন্য তার গুলশানের বাসার সামনে বালু ও ময়লার ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর নিষিদ্ধ পিপার স্পে করা হয়। এতে খালেদা জিয়াসহ অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
দেশে-বিদেশ অঢেল সম্পদ: পুলিশ অফিসার চাকরি জীবনের অন্তত ১৫ বছর কাটিয়েছেন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গুলশানে। এখানেই তিনি পরিদর্শক থেকে ধাপে ধাপে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছেন এডিসি। ঘনিষ্ঠদের নিয়ে এখানে গড়েন নিজস্ব সিন্ডিকেট। এভাবে অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়ে দেশে-বিদেশে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। লন্ডনে তৈরি করেছেন বাড়ি, যেখানে থাকেন বাবা নায়েব হাজি এবং মাকে নিয়ে থাকেন সেজো ভাই আজিজুল ইসলাম। সেজো ভাই আজিজুলের সিটিজেনশিপও রয়েছে লন্ডনে। দেশের ঘুষের টাকায় সেখানে তৈরি করেছেন অন্তত তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক এবং অভিজাতপাড়া গুলশান। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্রবিন্দু এ এলাকা। এ ছাড়া এই এলাকায় রয়েছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল ও মদের বার, সিসা লাউঞ্চসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রির অনুমোদিত ও অননুমোদিত স্পট। দিনের থেকে রাতে এই এলাকা বেশি জেগে থাকে। ধনীর সন্তানরা বুঁদ হয়ে থাকে বিভিন্ন নেশায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ম্যানেজ করেই চলে এসব কাজ, যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাকরিজীবীদের অন্যতম পছন্দের পোস্টিং এই গুলশান-বনানী। আর এই এলাকাতেই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চাকরি করেছেন রফিকুল ইসলাম। সরকারি চাকরির বিধান লঙ্ঘন করে একই এলাকায় দীর্ঘদিন থাকায় এখানকার বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার গড়ে উঠেছে গভীর সখ্য। এ ছাড়া নিজের ব্যক্তিগত সহকারীসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি অঘোষিত সিন্ডিকেট, যে সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়া গুলশানে কোনো কিছুই হতো না। ক্ষমতার পালাবদলে বদলি করা হলেও তিনি পদায়নকৃত পদে যোগদান করেননি। আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা এখন ফের বিএনপি-জামায়াতের অনুসারী সাজার চেষ্টা করছেন।
নেশার পার্টি অনুমোদন দিতেন রফিকুল: জানা যায়, গুলশানের বিভিন্ন বৈধ মদের বারের আড়ালে রাত হলেই আয়োজিত হয় অবৈধ ডিজে পার্টি। এসব পার্টিতে গিয়ে নেশা করে বুঁদ হয়ে থাকেন তরুণ-তরুণীরা। আর এসব পার্টির অনুমোদনের একটা চিঠিতে স্বাক্ষর করতে হয় এডিসি অ্যাডমিন হিসেবে রফিকুলকে। পার্টির আয়োজকরা জানান, প্রতিটি চিঠি স্বাক্ষরে ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নিতেন এডিসি রফিকুল। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেন সংক্রান্ত ঝামেলা হলে
বিচার-সালিশ বসাতেন তিনি। পছন্দের ব্যবসায়ীদের সুরক্ষাও দিতেন। তাদের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন মানুষকে
হুমকি-ধমকিও দিতেন নিয়মিত।
জানা গেছে, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিঞার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন এডিসি রফিকুল, যে কারণে পরোয়া করতেন না কাউকেই। আছাদুজ্জামানের আশীর্বাদেই দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এ ছাড়া যে কর্মকর্তাই গুলশানে ডিসি হিসেবে পদায়ন হতেন, রফিকুল তার সঙ্গেই স্থানীয় বৈধ-অবৈধ ব্যবসায়ীদের আলাপ করিয়ে দিতেন। যে কারণে গুলশানে সব কর্মকর্তা পরিবর্তন হলেও রফিকুল থেকেছেন স্বপদে। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে চারবার শান্তি মিশনে গেছেন পুলিশের এ কর্মকর্তা।
দেশে যত সম্পদ: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চার ভাইয়ের মধ্যে এডিসি রফিকুল সবার বড়। মেজো ভাই সফিকুল ইসলাম মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুর গ্রামে বসবাস করেন। সেখানে অর্থ লগ্নি করে রফিকুলের ছেলেকে নিয়ে যৌথভাবে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তিনি। সেজো ভাই আজিজুল ইসলাম বাবা-মাকে নিয়ে বসবাস করেন লন্ডনে। এডিসি রফিকের টাকায় লন্ডনে আজিজুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম যৌথ মালিকানায় বাড়ি ক্রয় করেছেন। ছোট ভাই নজরুল ইসলাম সিটি ব্যাংকের রাজধানীর একটি শাখায় কর্মরত। এ ছাড়া রফিকুলের দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। আর এক ছেলে থাকেন দেশে।
জন্মস্থান যতারপুর গ্রামে ৮ কাঠা জমির ওপরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে রফিকুল তৈরি করেছেন একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। রয়েছে ২০ বিঘার ওপরে
কৃষি-অকৃষিজমি। এর মধ্যে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অন্তত ১৭ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন মেজো ভাই সফিকুল ইসলামের নামে। আরও রয়েছে একটি রাইস ও গোডাউন মিল এবং
রড-সিমেন্টের ডিলারশিপের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন কয়েক কোটি টাকা। নামে-বেনামে চলছে কয়েকটি বাস, ট্রাক। ভাই-ভাতিজার নামে রয়েছে অন্তত পাঁচটি ট্রাক, একাধিক বাস ও দুটি লেগুনা। রফিকুলের অর্থায়নে এসব ব্যবসা পরিচালনা করেন তার ভাই ও ভাতিজারা।
গ্রেপ্তারের কয়েকদিন আগে কথা হয় এডিসি রফিকুল ইসলামের। দুর্নীতির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ইমানদার মানুষ। এসব অবৈধ টাকা খাওয়া হারাম। আমি অত্যন্ত সৎভাবে চাকরি করেছি। বাবা-ছেলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই লন্ডনের সিটিজেনশিপ, বাবা সেখানে মাঝেমধ্যে যায়-আসেন। আর ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় একটা ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করে।
বাস ও ট্রাকের বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘একটা বাস ও দুটি ট্রাক থাকতে পারে। এগুলো আমি ভালো জানি না। ভাইয়েরা পরিচালনা করেন। জমি ক্রয়ের বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন তিনি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post