টাকার জাজিমে (তোশক) না শুলে ঘুম আসত না আমির হোসেন আমুর। তিনি ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক। নতুন টাকার বান্ডিল আর স্বর্ণের নৌকা ছিল তার প্রথম পছন্দ। যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তাকে স্বর্ণের তৈরি নৌকা দিতে হতো। আর তদবিরের জন্য দিতে হতো ‘নতুন টাকার বান্ডিল’। নতুন টাকার বান্ডিল দিয়ে জাজিম বানিয়ে ঘুমাতেন তিনি।
আমির হোসেন আমুর অবৈধ সম্পদ দেখাশোনা করতেন তার ভায়রা ও সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ফখরুল মজিদ কিরন। তিনি আবার সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ হুমায়ূনের ভাই। তারও এপিএস ছিলেন কিরন। আমুর শ্যালিকা মেরী আক্তার ও কিরন দম্পতির কন্যা সুমাইয়াকে দত্তক নিয়েছিলেন নিঃসন্তান আমু। এই সুমাইয়া ও কিরনের কাছেই আমুর অবৈধ আয়ের অধিকাংশ গচ্ছিত রাখা। সুমাইয়া বর্তমানে স্বামীসহ দুবাইপ্রবাসী। সেখানে হুন্ডিসহ নানা উপায়ে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন আমু। এমন তথ্য জানান তারই ঘনিষ্ঠজন। ৫ আগস্ট রাতে আমুর ঝালকাঠির বাড়িতে লুটপাট শেষে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। সেখানে আগুনে পুড়ে যায় কোটি কোটি টাকা ও ডলার-ইউরো। আংশিক পোড়া অবস্থায় ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ও লাগেজ ভর্তি ডলার এবং ইউরো উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেখানে পাওয়া যায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা মিলিয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা। আমুর মগবাজার ও বরিশাল শহরের বাড়ি থেকেও ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিপুল পরিমাণ টাকা লুট হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আমির হোসেন আমুর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ জমা হয়। সেগুলো আমলে নিয়ে প্রাক-অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রাথমিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার ২০ কোটি ৩২ লাখ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার দুর্নীতি অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করেছে কমিশন।
প্রাক-অনুসন্ধানের পর গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমির হোসেন আমু তার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী, নৈশপ্রহরী ও আয়া নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন। এই খাত থেকে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া ঝালকাঠির এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল, গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ সব প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজে মোটা অঙ্কের টাকা অনৈতিকভাবে আদায় করতেন। ধানমন্ডির ১৫ নম্বর সড়কে ৭২৭/এ নম্বর বাড়িতে কেয়ারি প্লাজায় রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। সাভারের বাটপাড়া মৌজায় ৪৮ দশমিক ৭২ লাখ টাকা মূল্যের অকৃষি জমি এবং মিরপুরের রূপনগরে ১ কোটি ৩১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা মূল্যের বাণিজ্যিক প্লট। তার একটি গাড়ি রয়েছে। আমুর নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ও অন্যান্য বিনিয়োগ পাওয়া গেছে ১১ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ৮৩৮ টাকা। তার নিজ নামে মোট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ২০ কোটি ৩২ লাখ ১০ হাজার ৮৩৮ টাকা। উল্লিখিত সম্পদের বাইরে দেশ-বিদেশে বিপুল সম্পদ রয়েছে মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তার নিজ নামে, স্ত্রী ও অন্য আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে সম্পদ অর্জন করেছেন বলে গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে সঠিক পরিলক্ষিত হওয়ায় প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য কমিশন কর্তৃক সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে গত ৫ আগস্ট রাতে আমুর ঝালকাঠির বাসভবন থেকে ডলার ও ইউরোসহ প্রায় ৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। ওইদিন শহরের রোনালসে রোডের আমির হোসেন আমুর বাসভবনে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। ৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা লাগেজভর্তি টাকা ও ডলার দেখতে পান। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর সময় পানি নিক্ষেপ করলে পোড়া লাগেজ থেকে ডলার ও টাকার বান্ডিল বেরিয়ে আসে। একটি লাগেজে অক্ষত ১ কোটি এবং অন্য লাগেজগুলো থেকে গণনা করে আংশিক পোড়া ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ডলার ও ইউরো উদ্ধার করা হয় আরও প্রায় ৩ কোটি টাকার।
আমুর ঘনিষ্ঠজনরা জানান, ঢাকার মগবাজারের বাড়ি ছাড়াও আমুর বরিশাল শহরে ও ঝালকাঠিতে বাড়ি রয়েছে। আমু ব্যাংক লেনদেনে আস্থা ছিল না। তিনি সবসময় নিজের কাছে নগদ টাকা রাখায় বিশ্বাসী ছিলেন। টাকার জাজিম বানিয়ে তার ওপর ঘুমাতেন। কোনো তদবিরে কেউ তার কাছে গেলে তাকে ব্যাগভর্তি নতুন টাকার বান্ডিল দিতে হতো। এসব টাকা নিজের কাছেই রাখতেন। তার ভায়রা কিরনের মাধ্যমে এসব লেনদেন সম্পন্ন করতেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, টাকার জাজিমে না শুলে ঘুম আসত না আমির হোসেন আমুর। নতুন টাটকা টাকার বান্ডিল আর স্বর্ণের নৌকা ছিল তার প্রিয়। যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তাকে স্বর্ণের তৈরি নৌকা দিতে হতো। আর তদবিরের জন্য দিতে হতো নতুন টাকা। আমুর সম্পত্তির মধ্যে ঝালকাঠির রোনালস রোডে ভবন, বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডে প্রাসাদসম আলিশান বাড়ি এবং রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে একটি বাগানবাড়ি রয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর তেমন আস্থা বা ভরসা না থাকায় বস্তায় বস্তায় টাকা রাখতেন বাড়িতে, যার প্রমাণ মেলে ৫ আগস্ট। বিক্ষুব্ধ জনতা ওইরাতে হামলা, ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয় তার রোনালস রোডের বাড়িতে। ভাঙচুর চলাকালেই বহু মানুষকে টাকার বান্ডিল হাতে বের হতে দেখেছেন স্থানীয়রা।
ব্যক্তিজীবনে নিঃসন্তান আমু তার শ্যালিকা মেরী আক্তারের কন্যা সুমাইয়াকে দত্তক হিসেবে নিয়েছিলেন বহু বছর আগে। বর্তমানে দুবাইতে থাকা এই সুমাইয়ার বিয়ে হয়েছে দুবাইপ্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। অবৈধ পন্থায় আয় করা শতকোটি টাকা সুমাইয়ার কাছে পাঠিয়েছেন আমু।
ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এমন কোনো সেক্টর নেই যেখান থেকে টাকা পেতেন না আমু। সব টাকাই নগদে পৌঁছাত তার কাছে। লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন ভায়রা ফখরুল মজিদ কিরন। আমুর নাম ভাঙিয়ে কিরন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে আমুর এপিএস ছিলেন কিরন। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ হুমায়ূনেরও এপিএস ছিলেন এই কিরন। তিনি আমু ও হুমায়ুনের হয়ে সব তদবির নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিরনের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। সর্বশেষ শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ হুমায়ূনের আপন ছোট ভাই কিরন তার নিজের এলাকা ছেড়ে পড়ে থাকতেন ঝালকাঠিতে। কেবল সম্পদ ভান্ডারের দেখাশোনা আর পার্সেন্টেজ আদায় নয়, নির্বাচনী এলাকায় আমুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও দেখাশোনা করতেন তিনি।’
নলছিটি উপজেলার আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, আমুর সঙ্গে দেখা করতে হলে অনুমতি নেওয়া লাগত কিরনের। উন্নয়নমূলক সব কাজের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন তিনি। তার কথার বাইরে বলতে গেলে এক পা-ও চলতেন না আমু। পরিস্থিতি এমন ছিল—কিরন যেন ছিলেন ছায়া আমু। এই কিরনের মাধ্যমেই বিভিন্ন সেক্টর থেকে শতশত কোটি টাকা কামিয়েছেন আমু, যার প্রায় পুরোটাই এখন দুবাইয়ে কিরনের মেয়ে সুমাইয়ার কাছে আছে বলে ধারণা সবার।
নতুন টাকা ছাড়া আমুর আরেকটি শখ ছিল স্বর্ণের নৌকা। যে কোনো অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ করলে স্বর্ণের নৌকা উপহার দিতে হতো। তিনি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে স্বর্ণের নৌকা উপহার নেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বর্ণের নৌকা উপহার নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তখন থেকে আমু স্বর্ণের নৌকা নেওয়া বন্ধ করেন।
গত ১৮ আগস্ট আমুর ব্যাংক হিসাব জব্দ করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। একই সময় তার পালিত সন্তান ও মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও ব্যাংক লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে আর প্রকাশ্যে আসেননি আমির হোসেন আমু। তিনি দেশে আছেন না পালিয়ে গেছেন—সেই তথ্য নেই কোনো সংস্থার কাছে।
আমুর অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর আমির হোসেন আমুর বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ২০ কোটি টাকারও বেশি স্থাবর-অবস্থাবর সম্পদের অভিযোগ আনা হয়। প্রতিবেদন পাওয়ার পর অনুসন্ধানের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post