বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে রপ্তানি, রেমিট্যান্স আর রি-ইনবার্সমেন্ট অর্থাৎ শান্তিরক্ষী সেনা প্রেরণের বিনিময়ে প্রাপ্ত আয়ের ওপর নির্ভরশীল তা আজ সর্বজনবিদিত। এর মধ্যে রপ্তানির বিপরীতে দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা ও শিল্পাঞ্চলে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয় সরকারকে। শান্তিরক্ষী হিসেবে সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তুলতেও বহু সরকারি অর্থ ব্যয় হয়। এর বিপরীতে অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ করে সহজেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সহজ পথ বিদেশে শ্রমিক পাঠানো, যাদের অপর নাম রেমিট্যান্সযোদ্ধা। ১ কোটিরও বেশি রেমিট্যান্সযোদ্ধার বদৌলতে দেশ ও জাতি নানাভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। তারা সরাসরি বিদেশ থেকে বৈধ চ্যানেলে ডলার পাঠান এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে বা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকার জোগান দেন। বেকারত্ব হ্রাস তথা চাকরিসংক্রান্ত দাবিদাওয়া না করে তারাই বরং মূলধন খাটিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন।
একজন প্রবাসীর নিজের ও নিজ পরিবারের অন্তত চারজন সদস্যের ক্ষেত্রে সরকারি চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে হয় না। এর ফলে অন্তত প্রায় ৫ কোটি নাগরিকের চিকিৎসার দায়িত্ব নিজের অজান্তেই নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন প্রবাসীরা। তারা সন্তানদের জন্য শিক্ষা খাতে নিজস্ব ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হন না। এতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে চাপ কমে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা অধিকহারে সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। প্রবাসীরাই দেশের আবাসন শিল্পের মূল গ্রাহক এবং পুঁজিবাজারের অন্যতম বিনিয়োগকারী। বিমান পরিবহন ব্যবসার মূল গ্রাহকও এ প্রবাসীরা। নিজের বা পরিবারের কারও জন্য প্রবাসীদের সামাজিক নিরাপত্তার অধীনে কোনো ভাতা দাবি করতে দেখা যায় না। তাদের মাধ্যমেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে বৈধভাবে দেশে স্বর্ণ আসে এবং ধীরে ধীরে দেশে স্বর্ণের মজুত বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখা ১ কোটিরও বেশি প্রবাসী মূলত দুটি সমস্যার কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হন, যা হলো- ১. প্রবাসে অবস্থানকালে নিজ দেশের দূতাবাস থেকে কাক্সিক্ষত সেবা না পাওয়া বা অহেতুক বিলম্বে সেবাপ্রাপ্তি। ২. বিদেশ গমন ও দেশে আসার সময় বিমানবন্দরে বিড়ম্বনা। অথচ প্রযুক্তির জাদুকরী ছোঁয়ায় এ দুটি সমস্যার সমাধান তথা প্রবাসীদের জীবনে স্বস্তি এবং মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের প্রতিশ্রুতি যথাযথ মর্যাদা বা ভিআইপি মর্যাদা প্রদান সম্ভব।
প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে, প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকরা আমাদের দূতাবাসগুলোতে ভিড় জমান, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন, রাতে দূতাবাসের সামনেই পড়ে থাকেন বা আন্দোলন করে পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধি, তথ্য সংশোধন, এমআরপি পাসপোর্টের পরিবর্তে ই-পাসপোর্ট লাভ, ট্রাভেল পারমিট (টিপি) সংগ্রহ ইত্যাদির আশায়। অথচ উপরোক্ত চারটি সেবাই প্রযুক্তিনির্ভর অ্যাপস তথা ইন্টারনেটে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন, যাচাইবাছাই ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব। এটা কোনো নতুন ধারণা নয় বরং বিশ্বের বহু দেশে বহুল প্রচলিত ব্যবস্থাপনা। ঘরে বসে অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করে এ সেবা প্রদান করার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। বর্তমানে বিশ্বের বড় বড় দেশে থাকা প্রবাসীদের হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে দূতাবাসে আসতে হয়। এমনকি ছোট দেশে বা দূতাবাসের কাছে থাকা শ্রমিকদেরও ছুটি নিয়ে দিনভর অপেক্ষা করতে হয় এমন সেবার আশায় কাগজপত্র জমা প্রদান ও উত্তোলনের জন্য। অনলাইনে এমন সেবা পেলে কাউকে আর দূতাবাসে আসার প্রয়োজন হবে না। এতে কারও বেতন কাটা যাবে না বা দোকান বন্ধ রাখতে হবে না।
প্রবাসীদের মধ্যে যারা পরিবার নিয়ে বিদেশে থাকেন তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে দূতাবাসে আসতে হয়। বিদেশে কূটনৈতিকপাড়ায় জটলা দেখেই বোঝা যায় এটা বাংলাদেশি দূতাবাস। কারণ সেখানে লম্বা লাইন, তর্ক-বিতর্ক, অবৈধ লেনদেন, সস্তা হোটেলের ভ্রাম্যমাণ শাখা ইত্যাদি নানাবিধ উপসর্গ দেশের সুনাম নষ্ট করে। বিশেষত বহুদূর থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে আসা একজন শ্রমিক কোনো কারণে সময়মতো পৌঁছতে না পারলে তাঁর কাগজ সেদিন জমা করার কোনো সুযোগ থাকে না। তখন শুরু হয় একজন প্রবাসীর করুণ আর্তনাদ, অবৈধ লেনদেন, ফুটপাতে রাত কাটানোর মতো করুণ ঘটনা, যা দেশের ইমেজ নষ্ট করে। তথ্যপ্রযুক্তি তথা অনলাইনে আবেদন করা গেলে এ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে পারেন প্রবাসী শ্রমিকরা।
যেসব ক্ষেত্রে মূল পাসপোর্ট জমা প্রদান ও উত্তোলন একান্ত প্রয়োজন, সেক্ষেত্রেও ডাকযোগে কিংবা প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠন, স্কুল, মানি এক্সচেঞ্জ প্রভৃতির সহায়তা নেওয়া যায়, যা মধ্যপ্রাচ্যে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশের বহু দেশের দূতাবাস অনেক আগে থেকেই চালু করেছে।
প্রবাসীদের ভোগান্তি মূল সমস্যার দ্বিতীয়টি হলো- বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। অথচ ইতোমধ্যে স্থাপিত ই-গেটগুলো চালু করলেই ইমিগ্রেশন তথা বিদেশে যাওয়া-আসার সময় ই- পাসপোর্টধারীদের আর লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে না। ই-পাসপোর্টের স্পর্শে গেট খুলে যাবে বা বন্ধ হবে এবং আসা-যাওয়ার দিনক্ষণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রেকর্ড হবে। এ রেকর্ড বা তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থায় পৌঁছে যাবে। বিতর্কিত বা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কেউ অন্য কারও যোগসাজশে বিমানবন্দর বা স্থলবন্দর ব্যবহার করে দেশের সীমা অতিক্রম করতে পারবে না বা দেশে ঢুকতে পারবে না, ই-গেটেই তিনি আটকা পড়বেন। একইভাবে বিদেশের কোনো দাগি অপরাধী যদি ইন্টারপোল দ্বারা চিহ্নিত থাকেন, তাকেও ই-গেট শনাক্ত করতে পারবে।
আরও কিছু প্রযুক্তিনির্ভর সেবা প্রবাসীসহ সব নাগরিকের জীবন সহজ, স্মার্ট ও যুগোপযোগী করতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন ই-স্বাক্ষরযুক্ত শিক্ষা সনদ চালু হলে তা সত্যায়িত করার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাবে প্রবাসী ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং দক্ষতানির্ভর চাকরিপ্রত্যাশীরা। একইভাবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্সে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করলে যে কোনো কর্তৃপক্ষ সহজে যাচাই করতে পারবে। শারীরিক যোগ্যতা ও ভ্যাকসিনসংক্রান্ত সনদ ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদান এবং সংরক্ষণকরণে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল। আমরা সহজেই সেই অগ্রযাত্রার সহযাত্রী হতে পারি। অভিজ্ঞতা সনদপত্রসহ সব সনদ ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদান ও সংরক্ষণ আইন করে নিশ্চিত করতে পারলে এ-সংক্রান্ত প্রতারণা ও মামলা-মোকদ্দমা বহুলাংশে কমে যাবে। পরিবার নিয়ে প্রবাসীদের বিদেশে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক বিড়ম্বনার নাম কাবিন/ নিকাহনামা। অথচ বিবাহের কাবিন/নিকাহনামার সনদ ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদান ও সংরক্ষণ একটি অতি সহজ, নিরাপদ এবং ফলপ্রসূ প্রক্রিয়া। একই কথা প্রযোজ্য জন্ম ও মৃত্যু সনদের ডিজিটাল ভার্সনের ক্ষেত্রেও।
উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত স্মার্টফোনে ওপরের উল্লিখিত সব সনদের ডিজিটাল কপি (ভার্সন) রাখা এবং যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে তা প্রদর্শন ও জমা করা সম্ভব, যা উন্নত সব দেশেই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। অথচ বাংলাদেশে এসব সেবা এনালগ তথা মানুষের হাতের মুঠোয় বন্দি করে কর্মঘণ্টা অপচয়, অহেতুক কাগজ খরচ ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে থাকে। ডিজিটাল পদ্ধতি ছাড়াও কেবল জবাবদিহিতা, সুষ্ঠু পর্যবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ডাকযোগে বা তৃতীয় কোনো সেবা সংস্থার মাধ্যমে মূল পাসপোর্ট কাক্সিক্ষত ঠিকানায় পৌঁছানো গেলে প্রবাসী ও অন্য নাগরিকদের জীবন অনেক সহজ হবে এবং পাসপোর্ট অফিস তথা রাজধানী ও শহরকেন্দ্রিক চাপ এবং বিড়ম্বনা হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির অন্যতম উপায় হলো ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে অর্থ প্রেরণ। অথচ প্রবাসীরা বিশেষত প্রবাসী শ্রমিকরা সশরীরে উপস্থিত হওয়ার ঝামেলা নিতে চান না বলেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে আগ্রহ বোধ করেন না। প্রবাসীদের বিদেশ থেকে অনলাইনে আবেদন করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিলে ও উৎসাহিত করতে পারলে তদুপরি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার বিপরীতে উপযুক্ত প্রণোদনা পেলে প্রবাসীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। এতে বৈধ পথে রেমিট্যান্সের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
একজন প্রবাসীর জীবনে একটি পাসপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আইনি বৈধতার প্রতীক, যা কোনো অংশেই একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের চেয়ে কম নয়। সেক্ষেত্রে বৈধ পাসপোর্টধারী প্রবাসীদের পাসপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর কাজের চাপ ও প্রবাসীদের বিড়ম্বনা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। পাসপোর্ট ও জন্মসনদের মাধ্যমে মোবাইল মানি ট্রান্সফার (যেমন বিকাশ, নগদ ইত্যাদি) অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। প্রবাসীদের ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রেও পাসপোর্ট ও জন্মসনদের বিষয়টি বিবেচনা করা হলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ও বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।
যে কোনো বিচারে নাগরিক জীবনকে স্বস্তিদায়ক করতেই প্রযুক্তির উদ্ভব, উন্নয়ন, প্রচার ও প্রসার। বর্তমানে প্রবাসীদের বিড়ম্বনার মূলোৎপাটন করতে পারে প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ। যারা হাতে হাতে কাজ করা বা করানো থেকে নিজেরা অন্যায় সুবিধা আদায় করতে চায়, তারা পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে ধরে নিয়েই প্রযুক্তিনির্ভর প্রবাসী সেবা কার্যক্রম সামনে এগিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতাও। হটলাইন চালু করে কেউ যদি ফোন না ধরে তবে দোষটা প্রযুক্তির নয়, মানুষের।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post