পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়! সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই জনপ্রিয় কবিতার পংক্তি এখন উচ্চারিত হচ্ছে ইরানকে নিয়ে। ইসরাইলের হৃদপিন্ডে মিসাইলের বন্যা বইয়ে দিয়ে ইরান প্রমাণ করেছে, তারা মাথা নোয়াবার নয়। মধ্যপ্রাচ্যের তিন বীর কাসেম সোলাইমানি, ইসমাইল হানিয়া এবং নাসান নাসরুল্লাহকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে আপরেশন ট্রু প্রমিজ-টু শেষে এখন মুসলিম বিশ্ব বলছে- সাবাস ইরান!
মঙ্গলবার রাতে, মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ আলোকিত হয়ে উঠে ইরানের বিষ্ময় জাগানিয়া মিসাইল ভান্ডার থেকে একের পর মিসাইল উড়ে যেতে শুরু করার পর। এসব মিসাইলের গন্তব্য ছিলো ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও বিমান ঘাঁটি; যেসব ব্যবহার করে ‘দুষ্ট রাষ্ট্র’ ইসরাইল ধারাবাহিকভাবে ইরানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও স্থাপনায় অন্যায়ভাবে হামলা চালিয়ে আসছে। ইরানের ভাষায়, এই হামলা হচ্ছে সামান্য এক সতর্কবার্তা।
প্রায় দুশ’ ব্যালিসটিক মিসাইল দিয়ে ইসরাইলের মাটি ছারখার করে দেয়ার পর, তেহরান হুশিয়ারি দিয়েছে, তাদের ভূখণ্ডে কোনো হামলা আসলে, তারা ইসরাইলের সব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ওপর পাল্টা হামলা চালাবে। ইরানের এমন হুশিয়ারীর পর, ইসরাইল ও তার প্রধান দোসর আমেরিকা বৈঠকে বসেছে হামলার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার ফন্দিফিকির বের করার জন্য। প্রশ্ন উঠছে, কতটা উপযুক্ত হবে সেই জবাব।
এমন প্রশ্ন উঠার কারণও আছে। কারণ আর কিছুই নয়, ইরানের সামরিক সক্ষমতা। পারস্য সভ্যতার বাহক ইরানকে হেলাফেলা করার কোন কারণ নেই। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার বলছে, ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে। আমেরিকার দয়া-দাক্ষিণ্যে আকাশযুদ্ধে ইসরাইল এগিয়ে থাকলেও, ইরানের রয়েছে বিষ্ময়কর মিসাইল ভান্ডার। যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কারো কাছেই নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নিউইয়র্কার বলেছে, ইরানের ক্রুজ এবং ব্যালাস্টিক মিসাইল পারস্য উপসাগর জুড়ে শক্তির ভারসাম্য বদলে দিয়েছে। ইরানের সামরিক শক্তি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির প্রভাবশালী ভূমিকার কথা স্বীকার করে বলা হয়েছে, ইরান বর্তমানে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় একটি প্রভাবশালী দেশে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইরানের প্রভাব বা সামরিক শক্তি প্রতিহত করতে পারেননি।
আমেরিকার এই ম্যাগাজিন আরো লিখেছে, ইরানের কাছে শত শত ক্রুজ ও ব্যালাস্টিক মিসাইল রয়েছে। আরও আছে শব্দের চেয়ে কয়েকগুণ গতিসম্পন্ন হাউপারসনিক মিসাইল। যেগুলো ভূমি বা সাগর থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব। এসব মিসাইল অত্যন্ত নিচু দিয়ে উড়ে যেতে এবং একসাথে কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এসব মিসাইল কোনো রাডারে ধরা পড়ে না বলেও নিউ ইয়র্কার জানিয়েছে।
ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল শাহাব ওয়ানের উড়ালেন পাল্লা তিনশো’ কিলোমিটার পর্যন্ত। ভয়ঙ্কর ফাতাহ’র এর পাল্লা তিন থেকে পাঁচ’শো কিলোমিটার পর্যন্ত। শাহাব-টু ৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে পারে। আর, জোলফাগরের পাল্লা ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। কিয়াম ওয়ানের পাল্লা ৭৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত। আর, সাহাব-থ্রির পাল্লা দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত।
ইরানের মিসাইল ভান্ডারের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত শাহাব। ৬ ধরনের শাহাব মিসাইল রয়েছে ইরানের কাছে। রাশিয়ার এসএস-ওয়ান মিসাইলের আদলে তৈরি করা হয়েছে এগুলো। শাহাব-ফোর মিসাইলটি তিন হাজার কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত শত্রুদের ঘাঁটিতে আঘাত হানতে সক্ষম। আর, শাহাব-ফাইভ মিসাইলের ব্যাপারে ইসরাইলি মিডিয়াগুলো জানিয়েছে, ইরানের কাছে থাকা মিসাইলগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী।
ইরানের হাতে থাকা ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলোর মধ্যে ফাতাহ-১১০টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটিরও কয়েকটি সিরিজ রয়েছে। সমুদ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে সমুদ্রে এটি অনায়াসেই ব্যবহার করা যায়। ফাতাহ-থ্রি ওয়ান থ্রি, জুলফিকার-সেভেন জিরো জিরো, হরমুজ-ওয়ান এবং হরমুজ-টু সবই শক্রঘাঁটিতে ভালোভাবে আঘাত করতে পারবে। এসব মিসাইল বহু বিস্ফোরক ব্যবহার করতে পারে।
ইরানের কদর ওয়ান ওয়ান জিরো মিসাইলটি ইউরোপের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরানের দ্রুতগতির মিসাইল হিসেবে এটি অন্যতম। এ মিসাইলটি শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে অনায়েসে ঢুকে যেতে পারে। শত্রুদের রাডার অনেক ক্ষেত্রে এটিকে ধরতে সক্ষম হবে না বলে দাবি ইরানের। ইউরোপীয় সীমানা পর্যন্ত এই মিসাইল দিয়ে আঘাত হানা যাবে। তাই এটিকে হুমকি মনে করে ইউরোপ।
গোয়েন্দা পরামর্শক সংস্থা আরমামেন্ট রিসার্চের গবেষণা সমন্বয়ক প্যাট্রিক সেনফট বলেন, ইসরাইলে হামলায় ব্যবহৃত মিসাইলেন টুকরোগুলো বলছে, ইরান ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করেছে। এই ব্যালিস্টিক মিসাইল সাধারণ ক্রুজ মিসাইলে চেয়ে দ্রুত লক্ষ্যে পৌছায়। ইরানের বেশিরভাগ দূরপাল্লা হামলার ক্ষমতা এ মিসাইলে রয়েছে। উচ্চ গতির কারণে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এসবকে আটকে দেওয়া কঠিন।
শুধু মিসাইলই নয়, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতেও ইরান অভূতপূর্ব সফলতা দেখিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট ও ভয়েস অব আমেরিকার মতে, ইসরাইলে যেমন রয়েছে আয়রন ডোম, ডেভিড’স স্লিঙ্গ এবং অ্যারোর মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, তেমনি ইরানের হাতে রয়েছে নানা নামের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এসবের মধ্যে ‘আরমান’ ও ‘আজরাখস’ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চেয়েও উন্নত।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) বলছে, ইরানের ৫০টির বেশি মধ্যমপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার ও ১০০টির বেশি স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার রয়েছে। সম্প্রতি আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা করায়ত্ত করার চেষ্টা করছে ইরান। এর জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post