বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা- এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকার শুধু এক মাসেই ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্নি পর্যায়ে। বর্তমানে কর্মবিরতি ও হামলার ভয় কাটিয়ে কাজে ফিরেছে পুলিশ। পোশাক ও লোগো পরিবর্তনসহ নানান সংস্কারের মাধ্যমে বাহিনীকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলার কথা বলছে নতুন সরকার।
স্থানীয় জনপ্রতিধিদের অপসারণ করে তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে প্রশাসক। ব্যাংকখাত সংস্কারে সিদ্ধান্ত হয়েছে আলাদা কমিশন গঠনের। সেই সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে অনিয়ম-জালিয়াতির ঋণ ও পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার।
তবে গত এক মাসে বিভিন্নি পর্যায়ে কিছু বড় পরিবর্তন হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
পুলিশের থানায় ফেরা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাণ হারিয়েছে পুলিশ সদস্যরাও। যার ভয়াবহতা আরও তীব্র রূপ নেয় সরকার পতনের খবর নিশ্চিত হওয়ার পর পর। সারা দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে অন্তত ৪৫০টি থানা সহিংসতার কবলে পড়ে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে ভাঙচুর করে থানা জ্বালিয়ে দেওয়া অস্ত্র ও মালামাল লুট, এমনকী পুলিশ হত্যার ঘটনাও তখন ঘটতে দেখা গেছে। সরকার পতনের আগে-পরে সহিংসতায় সারা দেশে পুলিশের কমপক্ষে ৪৪ জন সদস্য নিহত হন বলে জানান কর্মকর্তারা।
এরপর পুলিশরা নিরাপত্তার দাবিতে কর্মবিরতি পালন করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর পুলিশের দাবি পূরণের আশ্বাস দেন।
কর্মস্থলে যোগ দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তিনি বলেন, ১৫ অগাস্টের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তিনি চাকরি করতে ইচ্ছুক নন বলে ধরে নেয়া হবে। এ অবস্থায় ১১ অগাস্ট কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে থানায় ফেরেন পুলিশ সদস্যরা।
প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল
এক মাসে সরকারের প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল দেখা গিয়েছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। অনেকেই হয়েছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওএসডি)। বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।
বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানসহ আরও অনেক কর্মকর্তাকে।
বিচার বিভাগে বড় পরিবর্তন
সরকার পতনের পর বড় পরিবর্তন এসেছে বিচার বিভাগেও। গত ১০ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরাও তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন।
এরপর নতুন বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন আপিল বিভাগের বিচারক সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একইভাবে আপিল বিভাগে নতুন আরও চার বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান।
পদত্যাগের হিড়িক
সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্নি পর্যায়ে আওয়ামী লীগ পন্থীরা নিজের অবস্থান থেকে পদত্যাগ করছেন। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে গত চার সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিগগিরই নতুন উপাচার্য নিয়োগ হবে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
৯ আগস্ট কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তার আগের দুইদিনে ডেপুটি গভর্নরসহ অন্তত চারজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সাদা কাগজে লিখিত দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়।
ড. ইউনূস ও খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল
সরকার পতনের পর পর বিচার বিভাগে পরিবর্তনের পাশাপাশি বদলেছে অনেক মামলার রায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেয়ার পর আওয়ামী লীগ শাসনামলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ড পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাজা বাতিল হয়ে যায়। সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেয়ার আগের দিন তাদের দু’জনেরই সাজা বাতিল করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
শেখ হাসিনার আমলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের জেল দেয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। কিন্তু সরকার পতনের একদিন পরেই রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন।
গতকাল ৪ আগস্ট মানহানির অভিযোগে দায়ের করা ৫টি মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন
আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা অনেক ব্যক্তিদের ধরে গুম করে দেয়ার গল্পই সামনে আসছে এখন। বর্তমানে আয়নাঘরের গল্পগুলো ভাবনা বাড়াচ্ছে জনসাধারণের।
এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য গঠন করা হচ্ছে বিশেষ কমিটি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান
ক্ষমতা গ্রহণের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারি কোন কাজে যেন আর দুর্নীতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে সেবা সহজ করার মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে বুধবার সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
তিনি আরও বলেন, সরকারি কেনাকাটায় যথার্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে।
আর্থিক খাত সংস্কারে উদ্যোগ
ব্যাংকিং খাতের টেকসই সংস্কারে ইতোমধ্যেই আলাদা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খুব শিগগিরই কমিশন গঠন করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
এছাড়া লুটপাটের শিকার হওয়া বেশ কিছু ব্যাংকের আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে বেসরকারিখাতে সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকও রয়েছে।
শিক্ষাখাতে যত পরিবর্তন
সরকার পরিবর্তনে বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও নানান পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতার মুখে গত ১৮ জুলাই মাঝপথে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা। সরকার পতনের পর সিদ্ধান্ত হয় বাকি পরীক্ষাগুলো নেয়া হবে ১১ সেপ্টেম্বরের পর।
এটা জানার পর পরীক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র একটি দল সচিবালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে ‘অনিবার্য কারণ’ দেখিয়ে গত ২০ অগাস্ট এইচএসসির বাকি বিষয়ের পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়।
ফলাফল কীভাবে হিসাব করা হবে, সে বিষয়ে স্পষ্টকরে কিছু বলা হয়নি। এ অবস্থায় এবার এইচএসসিতে অটোপাস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন।
চলতি বছর নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন তুলে দিয়ে নতুন যে শিক্ষাক্রম আওয়ামী লীগ সরকার চালু করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার সেটিতে সংস্কার এনে আবারও বিজ্ঞান মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জনপ্রতিনিধিদের জায়গায় প্রশাসক
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যূতির পর মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
পট পরিবর্তনের পর সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে কিংবা পরিষদে না যাওয়ায় নাগরিক সেবা ব্যাহতের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
স্থানীয় সরকারের ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি সরকারের।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সক্রিয় জামায়াত
ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ নম্বর ধারায় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’কে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় বসার তৃতীয় সপ্তাহে এসে সিদ্ধান্ত বদলে গেছে। বাতিল করা হয়েছে আগের প্রজ্ঞাপন। ফলে দলটির নেতাকর্মীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের পাড়া-মহল্লায় তাদেরকে জনসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে।
১৫ আগস্ট ছুটি বাতিল
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেওয়ার পর গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুদিন ১৫ অগাস্টে সারা দেশে ব্যাপক আয়োজনে শোকদিবস পালিত হতে দেখা গেছে।
জাতীয় দিবস হিসেবে ওইদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেটিও বদলে গেছে। গত ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে দাঁড়াতে দেয়নি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post