সবই আছে আগের মতো, নেই কেবল প্রাণভোমরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নিহত শিশু-কিশোরের পরিবারের অবস্থা এখন তাই। তাদের ছাড়া বাবা-মা-স্বজনের কাছে- ঘর যেন স্মৃতির কারাগার। আকাশ পরিণত হয়েছে বর্ণহীন হাহাকারে- যেখানে নেই কোনো পাখির কলতান-স্বপ্নের হাতছানি। গগণবিদারী কান্নায় সবার জিজ্ঞাসা- কেন? কী অপরাধ ছিল? কেন তছনছ হলো সাজানো ফুলবাগান?
কথা হয়, গুলিতে প্রাণ হারানো শিশু আহাদের বাবা আবুল হাসনাত শান্তর সাথে। শিশু আহাদের প্রাণটা ঝড়েছিল তার বাবা-মায়ের কোলেই। গ্রামের বাড়িতে আহাদকে চিরঘুমে রেখে ওই ঘরেই ফিরেছেন বাবা শান্ত। ঘরের প্রতিটি কোনায় কোনায় ছেলের স্মৃতি। আর ‘বাবা তোমার বুকেই থাকবো আমি’ কথাটি বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাবা শান্তর কানে।
আবুল হাসনার শান্ত বলেন, সেদিন সকালেও আমার বুকের ওপর শুয়ে ছিল সে। বলছিল, আব্বু তোমার বুকে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে। যখন অফিসে যাচ্ছিলাম ছেলে বলছিল আব্বু যেয়ো না। তোমার বুকে শুয়ে থাকবো। এরপরও যখন যাচ্ছিলাম বলে তোমার অফিসে আমাকেও নিয়ে যাও। কে জানতো এটিই হবে ছেলের শেষ কথা।
নারায়ণগঞ্জের ছোট্ট শিশু রিয়া গোপের বয়স হয়েছিল মাত্র ৬। খেলছিল বাড়ির ছাদে। গোলাগুলি শুরু হলে তাকে কোলে নেন বাবা। হঠাৎ একটি বুলেট মৃত্যুদূত হয়ে এসে লাগে রিয়ার মাথায়। এরপরই বিদায় নেন পরপারে।
বাবার সাথে খামারে কাজ করতো ১৩ বছরের মোবারক। দুধ বিক্রি করতো বাসায় বাসায়। বড় আগ্রহ ছিল খেলাধুলায়। ১৯ জুলাই মিছিল দেখতে গিয়ে নিভে গেছে তার জীবন প্রদীপ। বিষয়টি নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোবারকের বাবা বলেন, ছেলে বলেছিল সে খেলাধুলা করে তার নেমপ্লেট আসবে। তার নাম এসেছে তবে সেটি মৃত্যুসনদ, মেডিকেল প্রতিবেদন আর আজিমপুর গোরস্থানে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন মোবারকের মা-ও।
টিয়ারশেলের ধোঁয়া ঘরে আসছিল। তা ঠেকাতে জানালা বন্ধ করতে গিয়েছিল ১১ বছরের সামি। তখনই একটি গুলি এসে বিদ্ধ করে তাকে। ঘরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শিশুটি।
২০ জুলাই বিকেল, টিয়ারশেলের গ্যাসে রাজধানীর চিটাগং রোড এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না ১০ বছরের হোসাইনের। রাতে ঢাকা মেডিকেলে লাশের স্তুপের নিচে পাওয়া যায় তার মরদেহ।
১৮ জুলাই নরসিংদীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ যায় ১৪ বছরের তাহমিদের। নবম শ্রেণিতে পড়তো সে।
১৬ বছরের নাঈমা উত্তরায় বাসার বারান্দায় উদ্বিগ্ন মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাইরে কী হচ্ছে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি এসে লাগে তার গায়ে। সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী নাঈমা।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় রাস্তায় পড়ে থাকা আহত একজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল ১৬ বছরের ইফাত। হুট করে গুলি লাগে বুকের বাঁ পাশে। চলে যায় ইফাতের প্রাণটাও। ২০ জুলাই বিকেলে এমনিভাবে সাভার এলাকায় প্রাণ যায় ১৪ বছর বয়সী সাদ মাহমুদের। কৌতূহলবশত সড়কে নেমেছিল সে।
সাদ মাহমুদের ভাই রতন বলেন, ভাইটি ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো। ওইসময় বাড়ি ছিলাম না। তাকে বলেছিলাম কোথাও যাস না। তোকে আমি খেলার বুট কেনার টাকা দেবো। কোথাও যাবি না। এরপর ভোটভাইকে পাচ্ছিলাম না। শেষবার তাকে যখন পাই তখন সে গ্রিনলাইন হাসপাতালের আইসিইউতে। সেখান থেকে আর ফিরলো না।
সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ আর প্রাণ যাওয়াদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর আর তরুণ। তাদরে হারিয়ে অসীম শূণ্যতায় পরিবারগুলো। সন্তান ও স্বজনরা এসব পরিবারের মানুষের কান্না কে দেখে কে বা রাখছে তাদের খবর?
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post