বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়ে তাকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। সেই দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করার পরও আর দেশে ফেরা হয়নি তার। কারণ মহাকাশে থাকাকালে তার দেশটাই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছিল! তার নাম সের্গেই ক্রিকালেভ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এই মহাকাশচারী বিশ্বের প্রথম চার মহাকাশচারীদের একজন, যারা সবচেয়ে বেশি সময় মহাকাশে থেকেছেন।
সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদেনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, সব মিলিয়ে ৬ বার মহাকাশ অভিযানে গিয়েছেন ক্রিকালেভ। মোট ৮০৩ দিন ৯ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট মহাকাশে থেকেছেন। তিনি ছাড়া বিশ্বের আর মাত্র তিনজন মহাকাশচারীর এমন রেকর্ড রয়েছে। তবে ক্রিকালেভের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে আরও একটি কারণে। তার একটি অভিযান প্রায় এক বছর দীর্ঘায়িত হয়েছিল। টানা ৩১১ দিন থেকেছেন মহাকাশে।
ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ১৯৯১ সালের ১৯ মে ক্রিকালেভসহ আরও দুই নভোচারী মহাকাশে রওনা হন। ওই অভিযানের নাম ছিল সয়ুজ-টিএম ১২। এই মিশনের লক্ষ্য ছিল তিন মহাকাশচারীকে মহাকাশ স্টেশন মির (এমআইআর)-এ পৌঁছে দেওয়া। যাতে তারা সেখানে থেকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। মির ছিল সোভিয়েত পরিচালিত বিশ্বের প্রথম আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন মহাকাশ স্টেশন।
১৪৪ দিনের এই অভিযান শেষ হয় ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর। কিন্তু তিন মহাকাশচারীর দু’জন ফিরে এলেও ক্রিকালেভ ফিরতে পারেননি। তাকে পরবর্তী অভিযানের জন্য মিরেই থেকে যেতে বলা হয়। পরবর্তী অভিযানের নাম ছিল সয়ুজ-টিএম১৩। এই অভিযানে কোনও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন না। তাই ক্রিকালেভের ভরসাতেই একজন কমান্ডার আর দুই গবেষককে মহাকাশ স্টেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে মিরে বেশি দিন থাকতে পারেননি তারা।
সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। ১৯৯১ সালের ৪ অক্টোবর মিরে পৌঁছায় সয়ুজ-টিএম১৩। ছয় দিনের মধ্যেই দুই মহাকাশচারীকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। তারপরই বদলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস। ২৬ অক্টোবর কাজাখস্তান নিজেদের সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করে। এতেই বিপদে পড়েন ভৌগোলিকভাবে কাজাখস্তানের বাসিন্দা ক্রিকালেভ। কেননা তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারের হয়ে মহাকাশ অভিযান চালাচ্ছিলেন।
ত্রিকালেভ কিভাবে দেশে ফিরবেন, ফিরলে কোন দেশে ফিরবেন তা নিয়ে চলতে থাকে টালবাহানা। তার ওপর সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রটিও কাজাখস্তানের সীমানার মধ্যেই ছিল। এদিকে ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। মহাকাশে বসে সে কথা জানতেন না ক্রিকালেভ। হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি ক্রমাগত পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতে থাকেন।
মিরে তখন ক্রিকালেভের সঙ্গে ছিলেন কেবল সয়ুজ-টিএম ১৩-এর কমান্ডার আলেক্সান্ডার ভলকভ। কিন্তু ক্রিকালেভ আরও অন্তত পাঁচ মাস আগে থেকে মহাকাশে রয়েছেন। অন্তত ৩ হাজার বার পৃথিবী ঘুরে ফেলেছেন তিনি। এতে প্রভাব পড়ে তার শরীরে। এদিকে ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বরে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। জন্ম হয় একাধিক দেশের। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নাগরিক’ হিসেবে একাই মহাকাশে রয়ে যান ক্রিকালেভ।
মহাকাশের এই ‘কারাগারে’ কেটে যায় মাসের পর মাস। মহাকাশচারীদের কথা প্রায় ভুলেই যান সবাই। তবে তারা প্রাণপণ ফেরার চেষ্টা করছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার থাকা অবস্থায় বেতার তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন ক্রিকালেভ। তাই মহাকাশ স্টেশন থেকে একটি প্যাকেট রেডিওর সাহায্যে পৃথিবীতে নিয়মিত সংকেত পাঠাতেন তিনি। চাইতেন সাহায্য। অবশেষে বেশ কয়েক মাস পর এক অ্যামেচার নারী রেডিও অপারেটরের কাছে তার বেতারের সংকেত এসে পৌঁছায়।
অবশেষে ১৯৯২ সালের মার্চে ক্রিকালেভদের কথা মনে পড়ে প্রশাসনের। টানা ৩১১ দিন পর মহাকাশে থাকার পর পৃথিবীতে ফেরেন ক্রিকালেভ। কিন্তু ততদিনে তার শরীরের ওপর মহাকাশে থাকার প্রভাব পড়ে। মাধ্যাকর্ষণহীন মহাকাশ স্টেশনে টানা ১০ মাস থাকা, উচ্চ ভরবেগে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নিদেনপক্ষে ৫ হাজার বার ঘোরা— সব কিছু তার শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে। দুর্বল হয়ে যায় পেশি এবং হাড়ও।
তবে দীর্ঘ দিন নানা শারীরিক এবং মানসিক চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন ক্রিকালেভ। পৃথিবীতে ফেরার পরের বছরই আবারও মহাকাশে যাওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন তিনি। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে পাড়ি দেন মহাকাশে। তারপর আরও তিনটি মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়েছেন তিনি। নাসার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পদার্পণ করা প্রথম দুই মহাকাশচারীর একজন ছিলেন ক্রিকালেভ।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post