মহাকাশচারীরা দীর্ঘদিন মহাকাশে অবস্থান করলে তাঁদের শরীরে ঘটে যেতে পারে অদ্ভুত সব পরিবর্তন। বদলে যেতে পারে তাঁদের পেশি ও মস্তিষ্ক, এমনকি তাঁদের পাকস্থলীতে থাকা ব্যাকটেরিয়া।
এখন পর্যন্ত একজন মহাকাশচারীর টানা ৪৩৭ দিন মহাকাশে অবস্থান করার রেকর্ড রয়েছে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি রাশিয়ার মহাকাশচারী ভালেরি পলিয়াকভ ওই রেকর্ড গড়েন।
মার্কিন মহাকাশচারীদের মধ্যে ফ্রাঙ্ক রুবিও একবারে সর্বোচ্চ ৩৭১ দিন মহাকাশে ছিলেন। তাঁর আগে রেকর্ডটি ছিল ৩৫৫ দিনের।
বিবিসির খবরে বলা হয়, রুবিওর অবশ্য এত দিন মহাকাশে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি ও তাঁর সতীর্থদের মহাকাশ স্টেশন থেকে যে মহাকাশযানে ফেরার কথা ছিল, সেটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ২০২৩ সালের মার্চে তাদের মহাকাশে অবস্থানের সময় বাড়তে হয়।
ওই বাড়তি সময় মিলিয়ে রুবিও মহাকাশে যে ৩৭১ দিনে থেকেছেন, সে সময়ে তিনি ৫ হাজার ৯৬৩ বার পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণ করেছেন ১৫ কোটি ৭৪ লাখ মাইল (২৫ কোটি ৩৩ লাখ কিলোমিটার) দূরত্ব।
মহাকাশযান সোয়ুজ এমএস-২৩ যখন ধুলার ঝড় উড়িয়ে নিরাপদে কাজাখস্তানের শহর ঝেজকাজগানে ফিরে আসে, তখন রুবিওর মুখে ছিল আকর্ণবিস্তৃত হাসি। কিন্তু নিজের ক্যাপসুল থেকে তিনি একা বেরিয়ে আসতে পারেননি। উদ্ধারকারী দল তাঁকে বের করে নিয়ে আসে। লম্বা সময় ধরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) লো গ্রাভিটির মধ্যে থাকার কারণে তাঁর শরীরকে মূল্য চোকাতে হয়েছে।
ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে রুবিও বলেছিলেন, ‘মহাকাশে ৩৭১ দিন কাটানোর পর বাড়িতে ফিরে আসা দারুণ…।’
মহাকাশে রুবিওর এই বাড়তি সময় অবস্থান গবেষকদের সামনে দারুণ এক সুযোগ এনে দিয়েছে। লম্বা সময় ধরে মহাকাশে অবস্থান করলে মানবদেহ কীভাবে লো গ্রাভিটির ওই পরিস্থিতি মানিয়ে নেয় এবং সেখানে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালো উপায় কী হতে পারে, তা নিয়ে গবেষকেরা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ পাবেন।
সেসব বিশ্লেষণ থেকে যে তথ্য বেরিয়ে আসবে, তার ওপর ভিত্তি করে সৌরজগতের আরও গভীরে মহাকাশ অভিযান চালাতে গেলে কী কী সমস্যা হতে পারে এবং কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করা যাবে।
বিভিন্ন দেশ এখন মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, মঙ্গল গ্রহে যেতে এবং সেখান থেকে ফিরে আসতে প্রায় ১ হাজার ১০০ দিনের (তিন বছরের বেশি) মতো সময় লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া যে মহাকাশযানে মহাকাশচারীদের মঙ্গল গ্রহে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটির আকার আইএসএস থেকে অনেক ছোট হবে। যার অর্থ, সেখানে ব্যায়ামের জন্য ছোট এবং কম ওজনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়বে।
দীর্ঘ মহাকাশ ভ্রমণে মহাকাশচারীদের শরীর ফিট রাখার পাশাপাশি মানবদেহের ওপর দীর্ঘ ভ্রমণের প্রভাব নিয়েও তাই উদ্বেগ বাড়ছে।
বছরের পর বছর টানা মহাকাশে থাকার ফলে মানবদেহে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
পেশি ও হাড়ের ক্ষয়
মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ক্রমাগত টান খুব কম থাকার কারণে পেশি ও হাড়ের ঘনত্ব দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে মানুষের পিঠ, ঘাড়, ঊরু ও পায়ের হাঁটুর নিচের পেশিতে। মাইক্রোগ্রাভিটিতে যেহেতু সেগুলোর খুব বেশি কাজ করতে হয় না, সেহেতু সেগুলো ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে থাকে।
মহাকাশে মাত্র দুই সপ্তাহে পেশির ঘনত্ব ২০ শতাংশ পর্যন্ত এবং তিন থেকে ছয় মাসে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
একইভাবে হাড়ের ঘনত্ব ও শক্তিও কমতে থাকে। মহাকাশচারীদের মহাকাশে প্রতি মাসে হাড়ের ঘনত্ব ১ থেকে ২ শতাংশ কমে। ছয় মাসের বেশি হলে সেটা ১০ শতাংশের বেশি হয়। পৃথিবীতে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতিবছর হাড়ের ঘনত্ব গড়ে ০ দশমিক ৫ থেকে ১ শতাংশ কমে।
হাড়ের ঘনত্ব কমলে হাড়ে চিড় ধরার ঝুঁকি বাড়ে। চিড় সারতে সময়ও বেশি লাগে। মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফেরার পর একজন মহাকাশচারীর হাড়ের ঘনত্ব আগের অবস্থায় ফিরে আসতে চার বছরের বেশি সময় লাগে।
পেশি ও হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস আটকাতে মহাকাশচারীরা প্রতিদিন গড়ে আড়াই ঘণ্টা ব্যায়াম করেন। আর যখন আইএসএসে থাকেন তখন আরও বেশি শারীরিক কসরত করেন। আইএসএসে মহাকাশচারীদের জন্য ব্যায়ামাগার (জিম) রয়েছে।
স্বাস্থ্য ধরে রাখতে তাঁরা বিভিন্ন সাপ্লিমেন্টও সেবন করে।
তবে এত সব ব্যায়াম ও কসরতের পরও মহাকাশে নভোচারীদের পেশির ক্ষয় হ্রাস খুব একটা আটকানো যায় না বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
ওজন কমে যায়
যদিও মহাকাশে ওজনের তেমন কোনো প্রভাব নেই। মাইক্রোগ্রাভিটিতে কিছু ফেলে দিলে তা মাটিতে পড়বে না। সব বাতাসে ভেসে বেড়াবে, মানুষও। তাই মহাকাশে স্বাস্থ্যকর ওজন ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।
ওজন ঠিক রাখতে নাসা চেষ্টা করছে তাদের নভোচারীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে। এ জন্য তারা সম্প্রতি মহাকাশ স্টেশনে সালাদ হিসেবে খাওয়া যায় এমন পাতার চাষ শুরু করেছে। কিন্তু এত কিছুতেও মহাকাশচারীদের শরীরে মাইক্রোগ্রাভিটির প্রভাব কমানো যাচ্ছে না।
দৃষ্টিশক্তিতে পরিবর্তন
পৃথিবীতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মানবদেহে রক্তপ্রবাহকে নিচের দিকে ধাবিত হতে সাহায্য করে। হৃদ্যন্ত্র পাম্প করে আবার রক্তকে ওপরে তোলে। মহাকাশে এই প্রক্রিয়ায় পুরো জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যায় এবং রক্ত স্বাভাবিকের থেকে বেশি সময় মাথায় জমা থাকতে পারে।
মাথায় জমে থাকা ওই রক্তের কিছু অংশ চোখের পেছনে এবং অপটিক নার্ভে জমে যেতে পারে। ফলে চোখ ফুলে যেতে পারে। এতে দৃষ্টিশক্তিতে পরিবর্তন হতে পারে এবং দেখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এমনকি চোখের গড়নেও পরিবর্তন আসতে পারে। মহাকাশে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে এ সমস্যা শুরু হতে পারে এবং দিন যত বাড়ে ঝুঁকিও তত বাড়তে থাকে।
নভোচারীরা পৃথিবীতে ফেরার পর দৃষ্টিশক্তি ও চোখের আকার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে বছর খানিক লেগে যায়। কারও কারও বেলায় সমস্যা স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
গ্ল্যাকটিক কসমিক রশ্মির সংস্পর্শে আসার কারণে এবং এনার্জেটিক সোলার পার্টিকেলের কারণে চোখে আরও বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল আমাদের এসব থেকে রক্ষা পেতে সহায়তা করে। কিন্তু মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশচারীদের এসব থেকে রক্ষা করার কেউ নেই। যদিও মহাকাশের এই তীব্র আলোকরশ্মি থেকে নভোচারীদের রক্ষা করতে মহাকাশযানে নানা সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু মহাকাশ স্টেশনে অবস্থানের সময় মহাকাশচারীরা তীব্র আলোর ঝলক দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এই কসমিক রে ও সোলার পার্টিকেল মহাকাশচারীদের রেটিনা ও অপটিক্যাল নার্ভের ক্ষতি করে।
স্মায়ুসংক্রান্ত সমস্যা
নাসার মহাকাশচারী স্কট কেলি আইএসএসে ৩৪০ দিন ছিলেন। পৃথিবীতে ফিরে একটি বিস্তৃত গবেষণায় অংশ নেন তিনি। মহাকাশে দীর্ঘদিন অবস্থানের ফলে মানবদেহে তার কী প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে ওই গবেষণা চালানো হয়। কেলির যমজ ভাই পৃথিবীতে ছিলেন। কেলি ফেরার পর দুই ভাইয়ের স্বাস্থ্যগত অবস্থা নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, মহাকাশ থেকে ফেরার পর কেলির একাগ্রতায় তেমন কোনো পরিবর্ত হয়নি। কেলির ভাই ও তাঁর এ বিষয়ে দক্ষতা প্রায় একই আছে।
তবে গবেষকেরা দেখেছেন, মহাকাশ থেকে ফেরার প্রায় ছয় মাস পর কেলির একাগ্রতায় ক্ষিপ্রতা ও নির্ভুলতার মাত্রা কিছুটা কমেছে। এর কারণ হতে পারে, তাঁর মস্তিষ্ক পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং বাড়িতে মহাকাশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
ভালো ব্যাকটেরিয়া
গত কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, মানবদেহের সুস্বাস্থ্যে অনেকাংশে দেহের ভেতর ও ওপরে বসবাসকারী অণুজীবের গঠন ও বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে।
আমরা যে খাবার খাই, সেটা কীভাবে হজম হবে, তা এই অণুজীবের ওপর নির্ভর করে। দেহের ওপর প্রদাহের প্রভাব কেমন হবে, সেটাও অণুজীবের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এমনকি আমাদের মস্তিষ্কের কাজের ধরনও পরিবর্তন করতে পারে এই অণুজীব।
গবেষকেরা দেখেছেন, কেলি মহাকাশে যাওয়ার আগে ও মহাকাশ থেকে ফেরার পর তার পাকস্থলীর ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে।
তবে এটা খুব বেশি অবাক করার মতো নয়। কারণ, আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাই এবং আমাদের আশপাশে যেসব মানুষ বসবাস করে, তার ওপর আমাদের শরীরে অণুজীবের উপস্থিতি নির্ভর করে। মহাকাশে নানা রশ্মির সংস্পর্শে আসা, রিসাইকেল করা পানি পান করা এবং শারীরিক সক্রিয়তায় বড় পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
সংবেদনশীল ত্বক
মহাকাশে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর পৃথিবীতে ফিরে আসা নভোচারীদের ত্বক অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। র্যাশও দেখা দেয়। মহাকাশে থাকার সময় ত্বকে উদ্দীপনা কম থাকার কারণে এমনটা হতে পারে।
জিনগত পরিবর্তন
কেলিকে নিয়ে গবেষণায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফলাফল হচ্ছে, মহাকাশে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে তাঁর ডিএনএর পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারা। আমাদের ডিএনএর উভয় প্রান্ত টেলোমেয়ার দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এই টেলোমেয়ার টেলোমেরাস নামক এনজাইম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। টেলোমেয়ার জিনের ক্ষয় রোধে সহায়তা করে।
যখন আমাদের বয়স বেড়ে যায়, টেলোমেয়ার ছোট হতে থাকে। কেলি ও অন্য নভোচারীদের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, মহাকাশ ভ্রমণে টেলোমেয়ারের আকারে পরিবর্তন হয়েছে।
দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা
মহাকাশ ভ্রমণে যাওয়ার আগে, মাঝখানে ও ফিরে আসার পর কেলিকে বেশ কিছু টিকা দেওয়া হয়েছে। মহাকাশ থেকে ফিরে আসার পর পরীক্ষায় তাঁর দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। বরং স্বাভাবিকই ছিল।
তবে কয়েকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মহাকাশে নানা তেজস্ক্রিয়া রশ্মির সংস্পর্শে আসায় নভোচারীদের রক্তে শ্বেতকণিকা অনেক সময় কমে যায়।
মহাকাশে দীর্ঘসময় অবস্থানের ফলে মানবদেহে কী কী পরিবর্তন ঘটতে পারে, তা নিয়ে আরও বেশ কিছু গবেষণা চলছে। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। তাহলেই হয়তো স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post