জরুরি প্রয়োজনে পণ্য আমদানিতে ডলার সংগ্রহ করতে বিপাকে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে ১১৮ টাকা থেকে ১২৬ টাকা পর্যন্ত। অথচ ডলারের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১১ টাকা। বাড়তি দরে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
এ কারণে পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তারা । বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১১১ টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ দরে কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
ক্ষেত্রবিশেষ প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা থেকে ১২৬ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর এর কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে রেমিট্যান্স আহরণ করতে তাদের ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।
আর বাড়তি দামে ডলার আহরণ করে বাড়তি দামে বিক্রি না করলে ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়বে। এ লোকসানের ভাগিদার কে হবেন। এ কারণেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণে সর্বোচ্চ দর বেঁধে দিয়েছিল ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা)। বলা হয়েছিল রেমিট্যান্স আহরণে ব্যাংকগুলো ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দেবে। এর বাইরে ব্যাংকগুলো
নিজস্ব তহবিল থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারে। সে হিসেবে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলােের দাম সর্বোচ্চ ১১৩ টাকা পর্যন্ত দিতে পারে। কিন্তু এ দর বেশির ভাগ ব্যাংকই মানছে না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে শৃঙ্খলা আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এবিবি ও বাফেদা ডলারের দর নির্ধারণ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে যেসব ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংগঠন দু’টি থেকে একাধিকবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়।
ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করার দায়ে ১০টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কঠোর অবস্থানের কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। কমে যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও।
ডলারের জন্য ব্যাংকগুলোতে হাহাকার পড়ে যায়। অনেক ব্যাংক বকেয়া এলসির দায় পরিশোধ করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকে দ্বারস্থ হয়। কিন্তু রিজার্ভ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেসরকারি কোনো ব্যাংক সহযোগিতা করেনি বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। বাধ্য হয়ে এবিবি ও বাফেদার সিদ্ধান্ত অমান্য করে বেশি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করে বেশির ভাগ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কেউ কম দামে রেমিট্যান্স আহরণ করছে, আবার কেউ বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে। যারা বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে তারা আবার বেশি দরে গ্রাহকের কাছে ডলার বিক্রি করছে। আবার যারা কম দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে তারা কম দরে ডলার বিক্রি করছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হওয়ার পরিবর্তে মূলত বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এতে পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়ছে।
সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। অপর দিকে নিয়ম পরিপালন করতে গিয়ে কিছু ব্যাংক বেকায়দায় পড়ে গেছে। তারা রেমিট্যান্স আহরণে পিছিয়ে পড়ায় ডলার সঙ্কটে পড়েছে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করতে পারছেন না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যাংকাররা।
তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের তৃতীয় ধাপের কিস্তি পেতে মার্চের জন্য নির্ধারিত ১৯.২৬ বিলিয়ন ডলার নেট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।
কিন্তু এ থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার কম ছিল। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের আন্তঃপ্রবাহ বাড়াতে বেশি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ সায় ছিল। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকও চায় দেশে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স আসুক। আর এ কারণেই বাড়তি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তেমন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে।
ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ঈদের আগের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল রেমিট্যান্স আহরণের দর কম দেয়া। আর এ কারণেই ঈদের পর থেকে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে ১১৬-১১৭ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে।
অন্তত ১০-১২টি ব্যাংক এই রেটে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করছে। যেখানে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে রেমিট্যান্সের এই ডলারের দাম ১১২.৫ থেকে ১১৩ টাকায় নেমে গিয়েছিল। অবশ্য ফেব্রুয়ারির শেষে রেমিট্যান্সের ডলারের জন্য ১২০-১২২ টাকা পর্যন্ত অফার করেছিল ব্যাংকগুলো।
বেশি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করতে হচ্ছে। আর এ কারণে বেশি দামেই বিক্রি করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দাম নেয়া হচ্ছে করপোরেট ডিলিংয়ের ক্ষেত্রে। আর এ করপোরেট ডিলিং হলো, কোনো গ্রাহকের ১৫ দিন পরে ডলার প্রয়োজন হবে।
আমদানি দায় মেটাতে তাই ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আগাম ডলারের চাহিদাপত্র দেয়া হয়। আর এর জন্য প্রতি ডলারে কিছু বাড়তি দাম গুনতে হয় যা ব্যাংকিং ভাষায় প্রিমিয়াম নামে পরিচিত। আর এ পদ্ধতিতে ডলার আহরণ করতে গিয়ে ক্রেতাদের প্রতি ডলারে ১২৬ থেকে ১২৮ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।
আর এভাবেই আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তা পর্যায়ে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post