ব্যাংকিং চ্যানেল বাদ দিয়ে অবৈধপথে আর্থিক লেনদেন তথা হুন্ডি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কাজ করার কথা জানিয়ে আসছে। কিন্তু কোনোভাবেই হুন্ডি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। হুন্ডি চক্র প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অভিনব সব পন্থায় অবৈধ লেনদেন চালিয়েই যাচ্ছে।
গত ৩১ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে হুন্ডি প্রতিরোধ নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, হুন্ডি প্রতিরোধে তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
রেমিট্যান্স আহরণের পথে বড় বাধা
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রেমিট্যান্স আহরণের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে হুন্ডি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে, মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিএফআইইউ হন্ডি তথা অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এ ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধসহ সব ধরনের অর্থ পাচার রোধে অন্যান্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। বিদেশে অবৈধভাবে বিভিন্ন মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার করে যাতে হুন্ডি করতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
বিএফআইইউ-এর তথ্য অনুযায়ী, হুন্ডি প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার বিষয়ে ছয়টি মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ডিস্ট্রিবিউটরের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে সিআইডি। এরমধ্যে দুটি ডিস্ট্রিবিউটরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হুন্ডি লেনদেনে জড়িত সন্দেহে ৫ হাজার ২৯টি এমএফএস এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত অভিযোগে ৫ হাজার ৭৬৬ জন এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে তাদের তথ্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে।
সিআইডি সূত্র জানায়,হুন্ডির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২১টি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ও এদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৩৯টি হিসাবের তথ্য এখন সিআইডির হাতে।
হুন্ডি সংশ্লিষ্ট নগদ ও সন্দেহজনক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্য ও ১৫১টি গোয়েন্দা প্রতিবেদনও রয়েছে তাদের হাতে। ডিজিটাল হন্ডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লেনদেন সহজে শনাক্তকরণের জন্য ইন্ডিকেটর প্রস্তুত করে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করা হয়েছে। ইন্ডিকেটরগুলোর আওতায় এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অনলাইন জুয়া ও হন্ডির সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৩৮ হাজার ১৪৩ টি ব্যক্তিগত এমএফএস হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।
অবৈধ হন্ডি, গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি সংক্রান্ত বিষয়ে এক হাজার ৪১টি ওয়েবসাইট, ১৭৯টি অ্যাপ এবং ৮০৩টি ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্ট্রাগ্রামের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ ও লিংক চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বিএফআইইউ’র পক্ষ থেকে।
হুন্ডি প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, হুন্ডি প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিএফআইইউ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। যার অংশ হিসেবে হুন্ডি প্রতিরোধে তারা বেশ কিছু কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে যাতে যাতে অর্থ পাচার না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অভিনব পদ্ধতিতে চলছে হুন্ডি
সিআইডি’র প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া হুন্ডি নিয়ে গত ৩১ মার্চ সাংবাদিকদের বলেছেন, জেট রোবটিক অ্যাপের মাধ্যমে অভিনব পদ্ধতিতে হুন্ডির সন্ধান পেয়েছেন তারা। এরপরই এই পথে হুন্ডির মাধ্যমে গত তিন মাসে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা আসতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে সিআইডি। এই চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের ডিভাইসগুলো জব্ধ করা হয়েছে। এই চক্রের সদস্যরা দুবাই থেকে এই ডিজিটাল হুন্ডির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি জানান, এ চক্রের মূল হোতা শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুন। মালয়েশিয়ান সফটওয়্যার ডেভেলপারের মাধ্যমে তৈরি করা অ্যাপ কাস্টমাইজ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে চক্রটি। তখন এজেন্ট সিমগুলো বাংলাদেশে থাকলেও এর নিয়ন্ত্রণ তারা দুবাই বসে করতে পারে। দুবাই বসেই তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন নম্বরে ক্যাশ-ইন এর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারে। তবে এর সঙ্গে জড়িত ও চিহ্নিতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ঈদকেন্দ্রিক হুন্ডি প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নিয়েছে সিআইডি—জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ডিআইজি কুসুম দেওয়ান গণমাধ্যমকে বলেন, শুধু ঈদকেন্দ্রিক নয়, হুন্ডি প্রতিরোধে সিআইডি সারাবছরই কাজ করে যাচ্ছে। এ নিয়ে তাদের নানা উদ্যোগও রয়েছে।
সচেতনতা সৃষ্টি
সংশ্লিষ্টরা জানান, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার প্রতিরোধে আপামর জনগোষ্ঠির মাঝে আর্থিক স্বাক্ষরতা বিস্তারে ২০২১ থেকে ২০২৬ মেয়াদে কর্মসূচি চলছে। এই কর্মসূচিতে হুন্ডি প্রতিরোধ ও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে রেমিটারদের এবং প্রবাসী কর্মীদের সচেতনতা বাড়াতে কাজ চলছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে ২৭টি দেশের ৩০টি শ্রম কল্যাণ উইং হন্ডি প্রতিরোধ ও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে উদ্বুদ্ধকরণ সভা করছে এবং লিফলেট বিতরণ করছে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা করে সেন্ট্রাল ব্যাংক টু সেন্ট্রাল ব্যাংকের যোগাযোগের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালার কথা বলা হয়েছে। নীতিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post