মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষ টিকতে না পেরে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বিজিপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। বিদ্রোহীরা দখল করে নিচ্ছে একের পর এক রাজ্য। এ পর্যন্ত পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন ৩২৮ জন বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি), সেনা সদস্য, পুলিশ সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক।
এরইমধ্যে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গোপনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। বিশেষ করে আরসা, আল ইয়াকিন, নবী হোসেন গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডার। এতদিন তারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সশস্ত্র অবস্থানে থেকে বিভিন্ন অপরাধ করে গেছে। শত শত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করার পর নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন এর দাবি কোনো অবস্থায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে দেবেন না তারা।
তথ্য মতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এরমধ্যে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। তারা মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসেন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ক্যাম্পের পাহাড়ী এলাকায় আস্তানা তৈরি করে আধিপত্য বিস্তারে গোলাগুলি, হত্যা, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। যদিও আশ্রয় শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রয়েছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পৃথক তিনটি ব্যাটালিয়ন।
রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য মতে, সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যাদের নাম শোনা যায় তাদের মধ্যে আরসা, আরএসও এবং নবী হোসেন বাহিনী অন্যতম। আরসা এবং আরএসও রোহিঙ্গাদের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলন করার দাবি করলেও নবী হোসেন নিজস্ব বাহিনী তৈরি করে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন। মিয়ানমারে সংঘর্ষ শুরুর আগে তার বাহিনী তোতার দ্বীপ নামক স্থানে আস্তানা গেঁড়েছিলেন।
নাফনদীতে তার অনুমতি ছাড়া কেউ মাছ ধরতে যেতে পারেন না। এমনকি তিনি নদীতে মাছ ধরতে টোকেন প্রথাও চালু করে নবী হোসেন। এছাড়াও ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে ইসলামি মাহাজ, মাস্টার মুন্না, পুতিয়া ডাকাত দল, জাকির ডাকাত দল, সালমান শাহ গ্রুপ, খালেক ও জাবু ডাকাত দল নামে ছোটবড় অসংখ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
ক্যাম্পে নিজেদের প্রভাব ও আধিপত্য ধরে রাখতে তারা একে অপরের সঙ্গে খুন, ডাকাতি, অস্ত্রবাজি করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এরইমধ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হলে ওপারে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও আরকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষে এড়াতে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঢুকে পড়ছে। এ অবস্থায় ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতা হতে পারে বলে মনে করেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।
বিশেষ করে মোস্ট ওয়ান্টেড নবী হোসেন বাহিনীর সঙ্গে আরসা ও আরএসও গ্রুপের সঙ্গে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভবনা বেশি। নবী হোসেনের বিরুদ্ধে মাদক পাচার, চাঁদাবাজি হত্যাসহ নানা অপরাধের ১২টি মামলা রয়েছে বাংলাদেশে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে নবী হোসেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টার সেঁটেছিল ৩৪ বিজিবি।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলতাজ হোসেন জানান, মিয়ানমার থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী নবী হোসেন তার অনুসারীদের নিয়ে মঙ্গলবার গভীর রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এতদিন তারা তোতার দ্বীপ নামক স্থানে আস্তানা গেড়ে বিজিপির হয়ে কাজ করত। আরকান আর্মির হাতে একের পর এক রাজ্য হারিয়ে কোণঠাসা বিজিপির সঙ্গে নবী হোসেন বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে ৩০-৩৫ জনকে স্থানীয়রা আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে।
পালংখালীর ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রহমতবিল ও আনজুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে অনেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের বেশিরভাগই অস্ত্র জমা দিয়ে বিজিবি হেফাজতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে এর বাইরে আরও অনেক অস্ত্রধারী ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকছে বলে জেনেছি। যদি এমন হয়ে থাকে তবে শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয় স্থানীয়রা চরম অনিরাপদ হয়ে যাবে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের ঢুকে পড়ার বিষয়ে তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, যেহেতু সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চলছে সেহেতু দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিক রাখতে সীমান্তে বিজিবি এবং ভেতরে শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এসব এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও। ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন এর সঙ্গেও নিয়মিত সমন্বয় করা হয়। তারপরও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।
ক্যাম্প-১১ এর মাঝি (নেতা) নুরুল কবির বলেন, সাধারণ রোহিঙ্গা এখন বিভিন্ন বাহিনীর কাছে জিম্মি। কখনো এটা, আবার কখনো ওটা আমাদের ওপর খবরদারি করে থাকে। সম্প্রতি মিয়ানমারের ঘটনার পরপর ওপার থেকে বেশ কিছু লোক ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে। তারা রাতে সক্রিয় হয়। সশস্ত্র অবস্থান নেয়। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।
ক্যাম্প-১৬ এর মাঝি (নেতা) ছুরুত আলম বলেন, অপরাধীরা সাধারণ রোহিঙ্গার মতো চলাফেরা করে। সন্ধ্যা হলেই তাদের রূপ পাল্টে যায়। ভয়ংকর হয়ে ওঠে অস্ত্রধারীরা। সন্ধ্যার পর পুরো ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অস্ত্রধারীদের হাতে। তাদের হেফাজতে অত্যাধুনিক অস্ত্রও রয়েছে।
এখন সীমান্তের ওপার থেকে যারা আসছে তারাও অস্ত্রধারী। এ কারণে যে কোনো সময় ক্যাম্পে বড় ধরনের সংঘাত তৈরি হতে পারে। তবে যেকোন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা হবে বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পে দায়িত্বরত ১৪ এপিবিএন এর অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ইকবাল।
তিনি বলেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাকি রাখতে আমরা সচেষ্ট রয়েছি। কোনো অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে দেওয়া হবে না। তবে একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই ক্যাম্পের বিশাল এলাকার ফাঁকফোকর দিয়ে আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে প্রবেশ করতে পারে। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত না।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post