মহানবী (সা.) হিজরতের আগে মক্কায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের অসম্ভব কঠিন এক পরিস্থিতি। তাকে উপেক্ষা করে মক্কার বায়তুল্লাহ প্রাঙ্গণে মহানবী (সা.)–এর সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি কাবা শরিফে মাকামে ইবরাহিমের কাছে দাঁড়িয়ে উচচ স্বরে সুরা আর রহমানের কিছু অংশ তিলাওয়াত করেন। কুরাইশ নেতারা তা শুনে হতবাক হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তারা তাঁর দিকে ছুটে গিয়ে নির্দয়ভাবে তাঁর মুখে আঘাত করতে থাকে। নির্যাতনের পরও তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর শত্রুরা আমার কাছে খুবই তুচ্ছ। আমি আবারও গিয়ে তাদের সামনে কোরআন তিলাওয়াত করব। তিনিই প্রথম মুসলমান যিনি প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করেছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)–র আবেগময় কোরআন তিলাওয়াতের প্রশংসা করে রাসুল (সা.) বলেছেন, কোরআর যেভাবে নাজিল হয়েছে, কেউ যদি সে অনুসারে সুন্দরভাবে তা তিলাওয়াত করে আনন্দ পেতে চায়, তাহলে সে যেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর মতো করে কোরআন তিলাওয়াত করে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)–র জন্ম মক্কায়। খুব অল্প বয়সে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি। ইসলাম গ্রহণের তালিকায় তাঁর নাম ষষ্ঠ। মক্কার অবিশ্বাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় তিনি হাবশায় হিজরত করেন। পরে সেখান থেকে ফিরে আসেন মক্কায়। কিছুদিন মক্কায় থাকার পর অনুমতি পেয়ে হিজরত করে চলে যান মদিনায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর নিজেকে রাসুলুল্লাহর একজন খাদিম হিসেবে উৎসর্গ করেন।
আবদুল্লাহ (রা.) রাসুল (সা.)–কে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। সফরে, ইকামাতে, ঘরের ভেতর বা বাইরে সব সময়ই রাসুলের (সা.) সঙ্গে তিনি থাকতেন। রাসুল (সা.) যখন নিজের ঘরে অবস্থান করতেন, সে সময়ও আবদুল্লাহ (রা.)–র সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল। এ কারণে তাঁকে ‘সাহিবুস সির’, অর্থাৎ রাসুল (সা.)–এর গোপন বিষয়ের অধিকারী বলা হয়।
নবী (সা.)–এর ঘরেই তিনি লালিত–পালিত হন। সাহাবিদের মধ্যে যাঁরা কোরআনের ভালো পাঠক, এর ভাব ও অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে খুব পারদর্শী এবং আল্লাহর আইন ও বিধানের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তাঁদের একজন। তাঁর অসাধারণ তিলাওয়াতের জন্য রাসুল (সা.) অন্যান্য সাহাবাদের তাঁর কাছ থেকে কোরআন শেখার নির্দেশ দিতেন।
রাসুল (সা.)–এর সঙ্গে সব গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। বদর, উহুদ, হুদাইবিয়া, খাইবারসহ মক্কা বিজয়েও তিনি রাসুলুল্লাহর (সা.)–এর সঙ্গী ছিলেন। হুনাইন যুদ্ধে কাফিরদের অতর্কিত আক্রমণে দশ হাজারের মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লে মাত্র ৮০ জন নিজের জীবন বাজি রেখে রাসুল (সা.)–এর চারদিকে অটল প্রাচীর তৈরি করে থাকেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ সেই বিরল ৮০ জনের একজন।
এ যুদ্ধে রাসুল (সা.) বিরোধী পক্ষের বাহিনীকে লক্ষ্য করে একমুঠো ধুলো নিক্ষেপ করেছিলেন। সে ধুলো রাসুল (সা.)–এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। হিজরি ২০ সনে উমর (রা.) তাঁকে কুফার প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। এ পদে তিনি ১০ বছর দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)–কে ঘিরে ইরাকের কুফায় কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন কোরআন গবেষণায়। তাঁর কোরআন শেখার পদ্ধতি ছিল খুবই চমৎকার! তিনি একটি আয়াত পড়ে তা আমল না করা পর্যন্ত অন্য আয়াত শিখতেন না। এভাবে সুরা বাকারা শেষ করতে তাঁর তিন বছরের বেশি সময় লেগেছিল।
একদিন রাসুল (সা.) দেখতে পেলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বসে বসে দোয়া করছেন। তাঁকে লক্ষ্য করে রাসুল (সা.) বললেন, চাও, দেওয়া হবে! চাও, দেওয়া হবে!
৩২ হিজরিতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর মেয়েদের নির্দেশ দেন যাতে তাঁরা প্রতি রাতে সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করে। কারণ তিনি রাসুল (সা.)–কে বলতে শুনেছেন, ‘প্রতি রাতে যে সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করে, দারিদ্র্য কখনো তাকে স্পর্শ করবে না।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post