বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান সংঘাতের ছায়া মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরাইল-হামাস সংঘাত বিশ্বের নজর কাড়লেও, এর বাইরেও অনেক মানুষ অবিরাম সহিংসতা ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।
চলতি বছরে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে উত্তর আফ্রিকার দেশ সুদানে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশটির আধা সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চলমান ওই সংঘাত বেশ তীব্র রূপ নিয়েছে; কিন্তু তা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।
সুদানে এ যুদ্ধের শুরু গত ১৫ এপ্রিল, দুই বাহিনীর ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব থেকে। একদিকে সেনাবাহিনী (এসএএফ), অন্যদিকে আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। একসময় মিত্র ছিল দুই বাহিনী। ২০২১ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তারা। কিন্তু আরএসএফকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে।
সুদানে চলমান সংঘাতের জেরে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এপ্রিলের মাঝামাঝি সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এছাড়া ১০ লাখের বেশি মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সংঘাতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছেন।
ইউরোপে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত কিংবা সবশেষ গাজায় ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে তৎপর দেখা যাচ্ছে, সেই তুলনায় আফ্রিকা অঞ্চলের সহিংসতা বন্ধে ওয়াশিংটনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কিন্ত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতা বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দুটি উদ্যোগ বড় প্রভাব রাখতে পারে। একটি হলো, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মিত্রদের অস্ত্র দেয়া বন্ধ করা এবং সুদান সংঘাত বন্ধে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম সামোই রুটোর উদ্যোগে সহায়তা করা।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পশ্চিম সুদানের দারফুরের পাঁচটি প্রধান শহরের চারটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আধা সামরিক বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শহর দখল করার পর থেকে আরএসএফ যোদ্ধারা সেখানে বেসামরিক বাড়িঘরে লুটপাট ও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
দারফুর মানবাধিকার গোষ্ঠীর মতে ,
“আরএসএফ যোদ্ধারা ৪ নভেম্বর আরদামাটা শহর দখল করার পর প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।”
আরএসএফের দখল করা সাউথ দারফুর প্রদেশের রাজধানী নিয়ালা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। এই শহরটি সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের সঙ্গে সুদানকে সংযুক্ত করেছে। এছাড়া আরএসএফের উৎপত্তি হয়েছিল এ দারফুরে। চলতি বছরের এ সংঘাতের সময় অঞ্চলটিতে অন-আরব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে। দারফুরে আরব এবং কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান সম্প্রদায়গুলো বছরের পর বছর ধরে সহিংসতায় লিপ্ত রয়েছে।
দুদশক আগে যখন বৈষম্যের অভিযোগ তুলে অন-আরব লোকরা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, তখন ভয়াবহ সহিংসতা শুরু হয়। আর আরএসএফের জন্ম হয়েছিল কুখ্যাত জাঞ্জাউইদ আরব মিলিশিয়া থেকে। গোষ্ঠীটি ওই বিদ্রোহকে নির্মমভাবে দমন করেছিল এবং কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। জাঞ্জাউইদ মিলিশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক নৃশংসতা এবং জাতিগত নিধনের অভিযোগ রয়েছে, যাকে একবিংশ শতকের প্রথম গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ঘোষণা করেন, জাঞ্জাউইদে ব্যাপক গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ওই অঞ্চলে গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক সৈন্য পাঠানোর আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ের উদ্যোগ সংকট মোকাবিলায় বেশ সফল হয়েছিল। এরই ধারাবহিকতায় ইউএসএইড এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ওই অঞ্চলে একটি বড় মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন শান্তিরক্ষীদের পাঠায়।
দারফুরে বেসামরিকদের হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও তদন্ত হয়। এ অভিযোগে সুদানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুদানের কর্তৃপক্ষ আল-বশিরকে দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে পাঠায়। এত কিছুর পরও কোনো শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানো যায়নি। যার ফলে ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
২০১৩ সালে সুদানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের এক ডিক্রির মাধ্যমে আরএসএফ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে তাদের পাঁচ হাজার মিলিশিয়া (সশস্ত্র) সদস্য অনেক আগেই সক্রিয় ছিল। ২০০৩ সালে দারফুরে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বশির যাদের ভাড়া করেছিলেন, পরবর্তীতে তারাই আরএসএফ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর আরএসএফ বাহিনীর কমান্ডারের নেতৃত্ব পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ হামদান, যিনি ‘হেমেতি’ নামে বেশি পরিচিত।
২০১৩ সালে আরএসএফ গঠিত হয়েছিল মূলত কুখ্যাত জাঞ্জাউইদ মিলিশিয়ার যোদ্ধাদের নিয়ে, যারা দারফুরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নৃশংসভাবে লড়াই করেছিল। এ বাহিনীর প্রায় ৪০ হাজার সদস্য ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের হয়ে অংশ নিয়েছিল।
সুদানে যে কারণে নতুন করে লড়াই
সুদানে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জেনারেলদের একটি কাউন্সিল দেশটি পরিচালনা করছে। কিন্তু পরে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে তৈরি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। মূলত কাউন্সিলের শীর্ষ দুই সামরিক নেতাকে ঘিরেই এ বিরোধ। এরা হলেন: জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান।
জেনারেল আল-বুরহান সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং সে কারণে তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে দেশটির উপ-নেতা জেনারেল মোহামেদ হামদান কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার। কিছুদিন আগেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে তারা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে আগামীতে দেশটি কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়েই এই দুই নেতার মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। বিশেষ করে সুদানের ভবিষ্যৎ এবং দেশটির বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবনা নিয়ে তারা ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেন।
শেষ মুহূর্তে দেশটিতে বেসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছিল। কিন্তু ওই সংলাপও ব্যর্থ হলে দুই বাহিনীর ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব থেকে ১৫ এপ্রিল সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দারফুর অঞ্চলের একটি কৌশলগত কেন্দ্র নিয়ালায় সুদানের সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়।
যুদ্ধ বন্ধে যে পদক্ষেপ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র
সুদানের যুদ্ধবিরতিতে নিয়ে আলোচনা করতে চলতি বছরের মে মাসে সৌদি আরবের জেদ্দায় শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রও জড়িত ছিল। তবে যুদ্ধরত দুপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
নভেম্বরের শুরুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে বেসামরিক নাগরিকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু না করার আহ্বান জানান। তবে সংকট সমাধানে বাইডেন প্রশাসনের তৎপরতায় যথেষ্ট ঘাটতি দেখা গেছে। যদিও জেদ্দায় যুদ্ধবিরতি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত ছিল, কিন্তু ব্লিঙ্কেনের আহ্বান সুদানে সংঘাত বন্ধে স্পষ্টতই কোনো প্রভাব ফেলেনি।
সুদান যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানকে সংঘাত বন্ধে কাজে লাগানো। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুদানের আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফকে আরব আমিরাত গোপনে অস্ত্র পাঠিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে দিয়েও সুদান যুদ্ধের ইতি টানতে পারেন বাইডেন। কারণ ইসলামপন্থিদের সঙ্গে জেনারেল আল-বুরহানের যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও কায়রো সুদানের সশস্ত্র বাহিনীকে সমর্থন করে।
অন্যদিকে যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেনিয়াকেও সহায়তা করতে পারে। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো এ সংকট বন্ধে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। গত জুন মাসে সুদানের যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম সামোই রুটো।
যদিও রুটো যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সুদানি দুই জেনারেলের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, ‘এরই মধ্যে দারফুরে গণহত্যার লক্ষণ’ রয়েছে। সংঘাত বন্ধে তিনি সুদানে আফ্রিকান শান্তিরক্ষীদের পাঠানোর পরামর্শও দিয়েছেন।
আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো যখন আফ্রিকার সংকট মোকাবিলার জন্য একটি প্রস্তাব দেয়, তখন বিশ্বশক্তি প্রায়শই তাদের মতভেদ দূরে রেখে প্রস্তাবকে সমর্থন করে। এখন ওয়াশিংটন যদি শুধুমাত্র জেদ্দায় যুদ্ধবিরতি আলোচনার দিকেই সব নজর রাখে, সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই এর কোনো সমাধান আসবে না।
ওয়াশিংটনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনো পদক্ষেপ না আসলে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি গণহত্যার ‘নীরব সাক্ষী’ হয়ে উঠার ঝুঁকিতে থাকবে। চাইলে বাইডেন এ ঝুঁকির পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। তবে এ পদক্ষেপ নিতে বাইডেনের হাতে আর খুব বেশি সময় নেই বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post