প্রবাসী এক মেয়ে অভিযোগ জানায়, সে পর্যটক (ভিজিট) ভিসায় আমিরাতে আগমন করেন। দালালের হাতে প্রতারিত হওয়া এই মেয়েকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। সর্বশেষ শারীরিক নির্যাতনে অসহ্য হয়ে পালিয়ে যাবার বিষয় অবগত করল মেয়েটি।
এই সময় কেবল দেশে ফিরে যাবার মিনতি ছিল তার। ভিজিট ভিসার মেয়াদ থাকায় বিমান টিকিট করে ফিরে যাবার সুযোগ আছে। কর্মকর্তাও তাই জানালেন। কিন্তু এসময় আর্থিক সহযোগিতা কে দিবেন- এটিই ছিল তার সামনে তখন সবচে বড় প্রশ্ন!
চট্টগ্রামের মাস্টার্স পড়ুয়া একটি মেয়ে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে বেশ কিছুদিন ধরে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজার একজন প্রবাসীর খোঁজ পান। ক্ষুদে বার্তা আর মোবাইল ফোনে আলাপ হয় তাদের। মেয়েটিকে জানানো হয় দুবাই-শারজায় শপিং মল ও পাঁচ তারকা হোটেলে তার জন্য কাজের বন্দোবস্ত হয়েছে।
সপ্তাহ খানিকের মধ্যে ভিসা হাতে পেলে বিদেশের উদ্দেশ্যে উড়াল দিতে হবে। সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে ওই ব্যক্তি। আরেকটু খোঁজখবর করতেই মেয়েটি জানতে পারে- কাজ দেয়ার নামে মূলত তাকে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য নেয়ার পরিকল্পনা করছে ওই চক্র।
একই ফাঁদে পড়ে দুবাই এসেছিলেন বরিশালের ভোলার আরেকটি মেয়ে। বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেল বিক্রির ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা খরচ করে ভাগ্যবদলের আশায় দুবাই পা রাখে মেয়েটি। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতেই তার সামনে ধরা দেয় বাস্তবতা। তার অভিযোগ, বিমানবন্দর থেকে বের হবার পরই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। রাখা হয় একটি গোপন কক্ষে। যেখানে টানা চার-পাঁচ দিন চলে শারীরিক নির্যাতন। বাধ্য করা হয় অনৈতিক কাজে। কিছুদিন পর অতিষ্ঠ হয়ে জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়ে যায় মেয়েটি।
ঢাকার এমন আরও একজন ভুক্তভোগীর খবর পাওয়া গেল। বিদেশে আসার আগে বলা হয় বাসাবাড়ির কাজ দিবে তাকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। যেই কাজে নিয়োজিত করা হলো, ওই কাজের জন্য মেয়েটি প্রস্তুত ছিল না মোটেও। তবু প্রবাসের অসহনীয় জীবনে জড়িয়ে যায় তার নাম। দালাল চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করতে তারই স্বামী স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে অনুনয় করে। যদিও ‘ভাই’ পরিচয়ে সাহায্য চান ওই ব্যক্তি।
পরে জানা গেল, আসল রহস্য। স্বামীর চেয়েও ভাই পরিচয়ে সাহায্য চাইলে দ্রুত সমাধানের রাস্তা বের হবার প্রত্যাশা ছিল তার। অবশ্য, পরে ওই মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব ইউএই’র সাংবাদিকদের সহযোগিতায় স্থানীয় প্রশাসন তাকে উদ্ধার করে।
এই চারজনের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ভাগ্যবদলের আশায় ছুটে আসা এমন অনেকেই এখন এসব গল্পের সঙ্গে পরিচিত। যাদের গল্প সামনে আসছে, তারাই স্থানীয় প্রশাসন বা বাংলাদেশ মিশনের সহযোগিতায় দেশে ফিরে যাবার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু অন্তরালে থেকে যাওয়া গল্পের চরিত্রগুলো কেবল নীরবেই কাঁদছেন। পরিবারের শেকল ভেঙে নিজের মতো বাঁচতে চাওয়া এই নারীদের কেউ কেউ ফের দালালের শেকলে বন্দি হয়ে পড়ছেন প্রবাসে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত নারীদের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ একটি দেশ। প্রাসঙ্গিক কারণে নারীকর্মীদের খুব বেশি অভিযোগ আসে না মিশনের কাছে। কথা হচ্ছে- তবে কেন নারীদের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ? পর্দার আড়ালে কেন কান্না তাদের ? এই প্রতারণার ফাঁদ পাতেন কারা ? কিভাবে তারা এই ফাঁদে পা রেখে আটকে পড়েন দালের জালে? জানা গেল, দালালদের নানা লোভনীয় গল্পের কথা।
ভুক্তভোগী নারীরা আসছেন দালালদের হাত ধরেই। দোকান, বিউটি পার্লার, সেলুন, নার্সিংয়ের কাজের প্রলোভন দেখানো হয় তাদের। ভাল অংকের বেতন, বিলাসী জীবনযাপনের গল্প শোনানো হয়। কেউ কেউ ফেঁসে যান প্রেমের জালেও। যেকারণে জেনে না জেনে এই ফাঁদে পা দেন নারীরা। এমন ফাঁদে পড়ে আমিরাতে আসা নারীর সংখ্যাও কম নয়। এদের বেশিভাগ ভিজিট ভিসা নিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করেছেন। বেদনার বিষয় হচ্ছে- ভিজিট ভিসায় প্রবেশের কারণে এদের সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য পাওয়া জটিল হয়ে যায়।
অথচ দেশটিতে নারীকর্মীদের জন্য সরাসরি কাজে ভিসা রয়েছে। গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ভিসায় যেমন সাধারণ ক্যাটাগরিতে নারীরা আসার সুযোগ পাচ্ছেন তেমনি শিক্ষিত ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নারীদের জন্যেও দেশটিতে রয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ। অবশ্য বর্তমানে ভাল প্রতিষ্ঠানিক চাকরির পাশপাশি অনেক বাংলাদেশি নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন দেশটিতে। যদিও পুরুষ শ্রমিক ভিসার জটিলতা এখনো কাটেনি।
তবে বাংলাদেশি নারীকর্মীর ভিসা বন্ধ হয়নি কখনোই। এমনকি গৃহকর্মীদের ভিসা সংক্রান্ত সম্পূর্ণ খরচ বহন করেন মালিক পক্ষ। ভিসার প্রক্রিয়া, ডাক্তারি পরীক্ষার খরচ, পরিচয় পত্র নবায়নসহ স্বাস্থ্য বীমা করে থাকেন তারা। পাশাপাশি মালিক পক্ষ থেকে সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন গৃহকর্মীরা। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রের ভিসাও সহজে পাচ্ছেন নারীরা। দেশটিতে থাকা দুটো বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা বিষয়টি বরাবরই নিশ্চিত করে যাচ্ছেন। সচেতন করছেন। শঙ্কার কথাও জানাচ্ছেন তারা। তার আগে জেনে নেয়া যাক বর্হিবিশ্বে নারীকর্মী সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান মতে, গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে বিশ্বের নানা দেশে নারীকর্মী গেছেন ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৫২০ জন। এরমধ্যে সর্বোচ্চ নারীকর্মী গেছেন- সৌদি আরবে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৯ জন, জর্ডানে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৬৭৫ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬৩ জন এবং ওমানে ১ লাখ ২০ হাজার ১২১ জন।
চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নারীকর্মী গেছেন ৭০ হাজার ৯৭০ জন। এরমধ্যে মধ্যেপ্রাচ্যের দেশেগুলোতেই গেছেন সিংহভাগ নারীকর্মী। তালিকায় সবার আগে রয়েছে সৌদি আরবের নাম। শতকরা ৬৫.৭৮ শতাংশ নারীকর্মী গেছেন দেশটিতে। এরপর ওমান ও জর্ডান।চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে ৪৬ হাজার ৬৮৩জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ হাজার ৮৫০ জন, কুয়েত ১ হাজার ১৬৮জন, ওমানে ৬ হাজার ৪২৪জন, কাতারে কাতার ৯৬৯ জন।
শঙ্কার কথা বলছিলাম। এই শঙ্কা খোদ বাংলাদেশ মিশনের। মিশন সূত্রে জানা গেল, অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে কখনও কখনও নারীরা আটক হচ্ছেন দেশটিতে। কারও কারও জেল হচ্ছে। কেউবা আইনি প্রক্রিয়া শেষে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। এই তালিকা স্বল্প হলেও দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্নে এটি বড় ইস্যু। প্রলোভনে পড়ে নিজের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলছেন এসব নারী।
মিশনের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কথোপকথনে বলছিলেন, ভুক্তভোগী কোন কোন নারী দেশ থেকে জেনে বুঝেই পা রাখেন এই পথে। দেশ ত্যাগের পর মাস ছয়েক সহ্য হলেও পরক্ষণে টিকে উঠতে না পেরে পালাতে বাধ্য হয় তারা। এরপরই মূলত অভিযোগ আসে মিশনে।
মিশনের আরেক কর্মকর্তা জানালেন, বৈধ পথে কর্মসংস্থান ভিসায় আসতে চাওয়া নারীদের বিষয়ে যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ থাকে। তারা যাচাই বাছাই করেন। কোনো গড়মিল পাওয়া গেলে ভিসা আটকে দেয়ারও সুযোগ আছে। কিন্তু যারা ভিজিট ভিসা করে দেশ পার হচ্ছেন তাদের আটকানোর তেমন সুযোগ নেই। আরো গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে- দেশীয় কোন কোন নারী ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে ভিজিট ভিসা করে দেশটিতে পা রাখছেন। তাদের ব্যাপারে মিশনের কিছুই করার থাকে না।
এসব বিষয়ে দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেনের বক্তব্য ছিল এমন- ‘নারীকর্মীদের খুব বেশি অভিযোগ আসে না। কারণ নারীদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত অত্যন্ত নিরাপদ। গৃহকর্মী হিসেবে যারা কাজ করছেন, তারা ভাল আছেন। তবে অভিযোগ এলে ভুক্তভোগী নারীদের উদ্ধার করে দেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় আইনে মামলা হলে সেখানেও বৈধ সহায়তা প্রদান করে মিশন।’
অন্যদিকে দেশটিতে থাকা আবুধাবি বাংলাদেশ দূতাবাস ও দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেটে এমন ভুক্তভোগী নারীকর্মীদের জন্য সেফ হোমের ব্যবস্থা নেই। মিশন থেকে ভুক্তভোগীদের জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় এই মূহুর্তে সেফ হোমের প্রয়োজনীয়তাও দেখছেন না এই কর্মকর্তা। তবে ভুক্তভোগী নারীরা দেশে ফিরেও অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। দেশে ফিরে জেলার ডিসি ও এসপির বরাবর আইনি সহায়তার জন্য আবেদন করা যায়। সেক্ষেত্রে দেশের ঠিকানা ও পাসপোর্টের তথ্য উল্লেখ করে আগেই মিশনকে একটি লিখিত অভিযোগ করতে হবে। ওই অভিযোগ পত্র নিয়ে নিজ থানায় মামলা দায়ের করার সুযোগ আছে ভুক্তভোগীদের।
এমন একজন ভুক্তভোগী বলছিলেন- ‘আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আমি চাইনা, আমার মতো কেউ আর প্রতারকের হাতে পড়ুক। মিথ্যা আশ্বাসে কেউ এখানে এসে প্রতারিত হোক।’ এই নারীকর্মীর অভিযোগ ছিল- এমন হাজারো মেয়ে তাদের অব্যক্ত আর্তনাদের চিঠি লিখছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সেসব অভিযোগের চিঠি পৌঁছে না কোথাও।
ওই নারীর অভিযোগের সূত্র ধরে বলতে চাই, নারীকর্মীদের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচাতে সরকারিভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে গ্রামীণ পর্যায়ে। যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যক্তি ও পারিবারিক সচেতনতা তৈরি উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বিদেশ গমনের আগে কাজের বিষয়ে আরো যাচাই-বাছাই করতে হবে নারীদের। তবেই শেকল ভাঙা নারীরা হয়ে ওঠবেন আমাদের অর্থনীতির বড় হাতিয়ার। পুরুষের পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহে রাখবেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post