রাজশাহীতে খেজুরের গুড়ের মৌসুম শুরু হয়েছে। খেজুর গাছের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। প্রতি বছরের মতো এবারও খেজুরের গাছের সংখ্যা বাড়ায় গুড় উৎপাদনও বেড়েছে। এতে রাজশাহীর গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে।
রাজশাহীর ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুরের গাছ রয়েছে বাঘা, পুঠিয়ায়, চারঘাট এবং দুর্গাপুর এলাকায়। এই চার উপজেলায় গাছের সংখ্যা ও গুড় উপাদন বেশি বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এছাড়া রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় খেজুর গাছের বাগান রয়েছে। সড়কে, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনায় খেজুর গাছ রয়েছে। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলায় একটি গাছে বছরে ২০ কেজি খেজুরের রস হয়। তা থেকে ৮ কেজি খেজুরের গুড় হয়। এছাড়া চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় মোট খেজুরের গাছ রয়েছে প্রায় ১১ লাখ ১৫ হাজারটি। আবাদ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫’শ হেক্টর জমিতে। এছাড়া মোট গুড়ের উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে ৯৫ লাখ কেজি বা সাড়ে ৯ হাজার মেট্রিক টন। আর বিক্রি হবে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার।
২০২২-২৩ মৌসুমের হিসেবে রাজশাহী জেলায় মোট খেজুরের গাছ ছিল ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি। আবাদ হয়েছিল ৫৪১ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমিতে। এছাড়া মোট গুড়ের উৎপাদন হয়েছিল ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪৬ কেজি বা ৮ হাজার ৮৬৪ মেট্রিক টন। রাজশাহীর শুধু বাঘা উপজেলায় চলতি মৌসুমে খেজুর গুড় থেকে ৩০ কোটি টাকা আয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে উদ্যোক্তা পেলে আমের মতো গুড় রপ্তানিতেও সরকার সহায়তার চিন্তা-ভাবনা করছে। এর জন্য ব্যসায়ী ও উদ্যোক্তা খোঁজা হচ্ছে।
এই উপজেলায় দুটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নে ৩০ হাজার ৩৮৯ জন কৃষি পরিবার রয়েছে। খেজুর বাগান রয়েছে ৪ হাজার। এছাড়া সড়কপথ, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনা মিলে দেড় লক্ষাধিক খেজুরগাছ আছে। একজন গাছি প্রতিদিন ৫০-৫৫টি খেজুর গাছের রস আহরণ করতে পারেন। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৪ হাজার গাছি রস সংগ্রহ করেন। প্রতি মৌসুমে তারা খেজুর গাছের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বাঘা বাজারের গুড় ব্যাবসায়ী এনামুল হক বলেন, চলতি শীত মৌসুমে প্রায় ৪০-৪৫ কোটি টাকার গুড় বেচা কেনা হবে। ফলে উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টাকা আয় করবেন। গাছিরা প্রতিদিন বিকেলে গাছে কোর (মাটির তৈরি হাড়ি) লাগিয়ে আসেন। আর সকালে রস ভর্তি কোর নামান। খেজুরের রস ও গুড় তৈরিকে কেন্দ্রে করে বছরের আড়াই থেকে তিন মাস ব্যস্ত থাকেন গাছিরা। প্রতি মৌসুমে খেজুর গাছের ওপর নির্ভর করে অনেকের জীবিকা।
কাটাখালীর হারিয়ান গ্রামের গাছি শমসের আলী। তিনি ২৬ থেকে ৩০ বছর ধরে খেজুরের গাছ লাগান। রস সংগ্রহ ছাড়াও তিনি গুড় তৈরি করেন। তার বেশির ভাগ খেজুরের গাছ এলাকাতেই। তিনি বলেন, প্রায় ১২০টি গাছের রস সংগ্রহ করেন। সে রসগুলো বাড়িতে জ্বাল করে প্রায় ২২ থেকে ২৫ কেজি গুড় তৈরি হয়। গুড় তৈরির জন্য জ্বালানি ও সামান্য কিছু কেমিকেলের খরচ বাদ দিলেও ভালো লাভ হয়। শুধু শীত মৌসুমে কাজ করলেও তার পুরো বছরের আয়-রোজগার হয়ে যায়।
এছাড়াও এই মৌসুমে গুড় তৈরিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও ভূমিকা থাকে উল্লেখযোগ্য। বেশির ভাগ বাড়িতে পুরুষ গাছ থেকে রস এনে দেওয়ার পরে অন্য কাজে চলে যান। এরপর রস জ্বাল করে তাক মতো নামান নারীরাই। তেমনি এক নারী রওমনআরা (৩৩)।
তিনি বলেন, আমার স্বামী ভ্যান চালান। ভোররাতে খেজুরের গাছ থেকে রস নামিয়ে বাড়িতে আনেন। এরপরে গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করে কাজে বেড়িয়ে যান। তারপর রস ছাকনা দিয়ে ছাকা হয়। এরপর চুলার ওপরে কড়াইয়ে দেই। গুড় না হওয়া পর্যন্ত জ্বাল করি। গুড় হয়ে গেলে সেগুলো ছোট ছোট পাত্রে ঢেলে রাখি। শক্ত হলে সেগুলো আবার কাগজে মুড়িয়ে রেখে দেই বিক্রির জন্য।
পুঠিয়ার ঝলমলিয়া হাটে গুড় বিক্রেতা জয় বলেন, সপ্তাহের দুদিন এখানে হাট বসে। প্রতি হাটে প্রায় কোটি টাকার গুড় বেচাকেনা হয়। এই গুড় দেশের বিভিন্ন বড় বড় বাজারে পাইকাররা নিয়ে বিক্রি করেন। আমাদের রাজশাহীতে বিদেশে পাঠানোর মতো অর্ডার আসে না। তবে ঢাকার আড়ত থেকে গুড় কিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা প্রবাসী বাঙালিদের কাছে খেজুর গুড় পাঠান।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সরকারি হিসেবে চলতি মৌসুমে মানুষ খেজুর গুড় থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা আয় করবেন। উপজেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গুড় উৎপাদনে সহায়তা দেওয়া হলে এই গুড়কে আরও লাভজনক করা সম্ভব। আমের মতো খেজুর গুড় বিদেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিদেশে রপ্তানি করা হলে এই গুড় থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবেন।’
তিনি আরও বলেন, গুড় রপ্তানীর জন্য এখনো আমরা কাউকে পাইনি। কোনো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা পেলে আমরা সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবো। গুড় রপ্তানীযোগ্য করতে যেসব প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে, সেসব পক্রিয়াগত সহযোগিতাও আমরাও করবো। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আগে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে আগে।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, দেশজুড়ে যেমন রাজশাহীর আমের খ্যাতি আছে তেমনি এখানকার সুমিষ্ট খেজুর গুড় প্রসিদ্ধ। জেলার গাছিরা শীত মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে গুড় তৈরি করেন। উৎপাদনকৃত গুড়গুলো উপজেলার হাটগুলোতে কেনাবেচা হয়। সেখান থেকে পাইকাররা কিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাট-বাজারে বিক্রি করেন। সেই গুড় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি করা হয়। এতে জেলার পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখন চাঙাভাব বিরাজ করছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post