সৌদি আরব ও ইরাক বেষ্টিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতকে গত তিনশ বছর ধরে শাসন করে আসছে দেশটির আল সাবাহ পরিবার। কুয়েতের সংবিধান অনুযায়ী, আমির এবং ক্রাউন প্রিন্স পদের উত্তরাধিকার ঐতিহ্যগতভাবে শুধুমাত্র মুবারক আল-সাবাহর বংশধরদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা আজ যে উন্নত কুয়েতকে চিনি তাকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সম্পূর্ণ যাত্রা জুড়ে ছিল এই পরিবারটি।
উপসাগরীয় যেকোনো নির্বাচিত সংস্থার চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে এই আল সাবাহ পরিবার। যেকোনো সরকারি এবং নির্বাহী পদের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাদের। দেশটিতে আমির পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এবং নির্বাচন ডাক দেওয়ার ক্ষমতাও রাখেন। এমনকি রাজনৈতিক বিষয়ে আমিরের কথাই শেষ কথা বলে স্বীকৃত। তবে পার্লামেন্টের বিরোধী দল প্রকাশ্যে সাবাহদের সমালোচনা করতে পারেন।
শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) দেশটির আমির নওয়াফ আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহর মৃত্যুতে সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। আল সাবাহ পরিবারের ইতিহাসে কুয়েত পিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, আল-সাবাহ মূলত পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উপজাতি গোষ্ঠী ‘আনাজা’ থেকে এসেছে।
যারা ছিল আদনানি আরব উপজাতি। অর্থাৎ যারা আনজা বিন আসাদ বিন রাবিয়া বিন নিজর বিন মাদ বিন আদনান বংশধারার অন্তর্ভুক্ত। কুয়েতের ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘দ্য অরিজিন অব কুয়েত’ বই অনুযায়ী, আল-সাবাহ পরিবারের উদ্ভব হয়েছে বনি উতবাহ সংঘ থেকে। সেখানে বলা হয়, ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য আরবে খরা দেখা দিলে সাবাহ পরিবার সেখান থেকে পালিয়ে প্রথমে দক্ষিণে যায়।
এরপর বিভিন্ন জায়গায় বসতি স্থাপনের চেষ্টা করলেও তারা পারেনি। পরে তারা উত্তর কুয়েতের পথে পা বাড়ান। সেখানে পানির উৎস খুঁজে পেলে শেষ পর্যন্ত স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। যাত্রার এই শেষ পর্যায়কে অ্যারাবিক ভাষায় আতাবু-ইলা আল-শিমাল বা উত্তরে সরে যাওয়া বলা হয়। সেখান থেকে বনি উতুব বা বনি উৎবাহ নামের উৎপত্তি। কুয়েতে বসতি স্থাপনের পরপরই সাবাহরা ওই অঞ্চল শাসন করতে শুরু করে।
মুখে মুখে প্রচলিত আরেক ইতিহাস অনুযায়ী, আল-সাবাহ পরিবার কুয়েতে বসবাসের আগে দক্ষিণ ইরান এবং ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে বসতি স্থাপন করেছিল। এরপর ১৭শ শতকের শুরুর দিকে আজকের কুয়েতে বসতি স্থাপন করে। সেখানে একজন সাবাহ নেতা হন, ১৭৬২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কুয়েত শাসন করেছেন।
আল-সাবাহ পরিবারের গোড়াপত্তন করেছিলেন আমির সাবাহ প্রথম জাবের আল-সাবাহ। যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৭৫২ থেকে ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত দেশটি শাসন করেছেন এখন তাদের ১৭তম বংশধর দেশের শাসনভার গ্রহণ করল। বর্তমানে কুয়েত বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেল সমৃদ্ধ দেশ এবং দেশটির জনসংখ্যা ৪৮ লাখ, যার মধ্যে ৩৪ লাখই বিদেশি কর্মী।
অটোমানদের হুমকির মুখে ১৮৯৯ সালে কুয়েতকে একটি ব্রিটিশ আশ্রিত দেশ বলে ঘোষণা করা হয়। সেই সময়ে সাবাহ পরিবার কুয়েতের আমির শাসন ক্ষমতায় থাকলেও ব্রিটিশ সংরক্ষণাধীন দেশ হিসাবেই বিবেচিত হতো। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করে কুয়েত।
• বহুদিন যুবরাজ ছিলেন শেখ নাওয়াফ
শেখ নাওয়াফ আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহ কুয়েতের ষোড়শ আমির এবং ১৯৬১ সালে দেশটি যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে তিনি ষষ্ঠ আমির। সেই থেকে তিনি দেশটির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছেন।
শেখ নাওয়াফ ১৯৩৭ সালের ২৫ জুন কুয়েত সিটির ফারিজ আল-শুইউখে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন কুয়েত সিটির দাসমান প্যালেসে। তখন তার বাবা শেখ আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহ কুয়েতের ক্ষমতায় ছিলেন। শেখ নাওয়াফ ছিলেন তার পঞ্চম পুত্র।
তিনি কুয়েতের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র আল মুবারকিয়াসহ বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। তিনি ১৯৫০-এর দশকে শরিফা সুলাইমান আল-জাসেম আল-ঘানিমকে বিয়ে করেন। ওই সংসারে, তাদের চার ছেলে এবং এক মেয়ে সন্তান রয়েছে।
শেখ নাওয়াফ ১৯৬২ সালে হাওয়ালি রাজ্যের গভর্নর থেকে শুরু করে ১৬ বছর ধরে অনেক রাজনৈতিক পদে আসীন ছিলেন। তারপর তিনি ১৯৭৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ইরাক যখন ১৯৯০ সালে কুয়েত আক্রমণ এবং দখল করে, তখন তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তুরস্কের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা আনাদোলুর খবরে বলা হচ্ছে, শেখ নাওয়াফ ২০০৬ সালে ক্রাউন প্রিন্স মনোনীত হন এবং টানা ১৪ বছর এই পদে ছিলেন।
তখন টানা দশ বছর আমির পদে ছিলেন তার সৎ ভাই শেখ সাবাহ আল-আহমাদ আল-সাবাহ। তিনি মারা যাওয়ার পর ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর শেখ নাওয়াফ আমির হন। এরপর তিন বছর ধরে তিনি তেল সমৃদ্ধ দেশটিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তাকে কুয়েত এবং আরব অঞ্চলের ‘‘প্রধান কূটনীতিক’’ বলা হয়।
• নতুন আমির শেখ মেশাল
শেখ নাওয়াফের মৃত্যুর পর কুয়েতের নতুন আমির হিসেবে ৮৩ বছর বয়সী শেখ মেশাল আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহ-এর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি শেখ নাওয়াফের চাচাতো ভাই। আমির হওয়ার আগে তিনি ক্রাউন প্রিন্স পদে ছিলেন। রয়টার্স বলছে, যখন শেখ নাওয়াফ অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন আমিরের বেশিরভাগ দায়িত্ব তিনিই পালন করতেন।
কুয়েতের সংবিধান এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, আমির মেশাল হলেন দেশের সপ্তদশতম শাসক এবং দেশের ইতিহাসে পার্লামেন্টের সামনে সাংবিধানিক শপথ গ্রহণ করা পঞ্চম শাসক।
কুয়েতের ক্রাউন প্রিন্সের ওয়েবসাইট অনুসারে, শেখ মেশাল ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং শাসক পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তিনিও আল-মুবারাকিয়া স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর যুক্তরাজ্যের হেন্ডন পুলিশ কলেজে পুলিশ সায়েন্স বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
১৯৬০ সালে স্নাতক পাস করার পর তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। এরপর তিনি বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। নতুন এই আমির যিনি ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন কুয়েতের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার জন্য তথ্য সংগ্রহ করে। শেখ মেশাল কুয়েতের নিরাপত্তা ও সামরিক খাতের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। আনাদোলু বলছে, শেখ মেশাল ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর ক্রাউন প্রিন্সের পদ গ্রহণ করেন।
তার পূর্বসূরির মৃত্যুর আগে শেখ মেশালও ডেপুটি আমিরের পদে আসীন ছিলেন। তিনি তার এক বক্তৃতায় মন্ত্রিপরিষদ এবং পার্লামেন্টের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। শেখ নাওয়াফের মৃত্যু কুয়েতের আমির শেখ নওয়াফ আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহ ৮৬ বছর বয়সে মারা গেছেন বলে শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) কুয়েতের রাষ্ট্রীয় টিভি ঘোষণা করেছে।
তার মৃত্যুর খবর ঘোষণার আগে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন তার নিয়মিত অনুষ্ঠানের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়ে কোরআন তেলাওয়াতে চলে যায়। তারপর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘শেখ নওয়াফ আল-আহমাদ আল-সাবাহর মৃত্যুতে আমরা গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করছি…।’’
কুয়েতের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা কুনা জানিয়েছে, গত মাসের শেষের দিকে জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে আমিরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অসুস্থতা বা মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তার এই মৃত্যুর ঘটনায় কুয়েতে ৪০ দিনের শোক ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি অফিস তিনদিন বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে বিশ্ব নেতারা শেখ নাওয়াফের মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা আল সাবাহ পরিবার এবং কুয়েতের জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেখ নওয়াফকে ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং সত্যিকারের বন্ধু’’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং তাদের মধ্যে ‘‘দীর্ঘদিনের সম্পর্ক জোরদার করার’’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post